Sun, September 29, 2024

ই-পেপার দেখুন
logo

আশুরার ইতিহাস ও আমাদের করণীয়: মুফতি মেনক


ইমামা খাতুন   প্রকাশিত:  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৫:৪৫ এএম

আশুরার ইতিহাস ও আমাদের করণীয়: মুফতি মেনক


 আরবি বর্ষ পরিক্রমার প্রথম মাস মুহাররম। আরবিতে বলা হয় 'মুহাররমুল হারাম'।   হাদিসে একে শাহরুল্লাহ তথা ‘আল্লাহর মাস’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ মাসের অনন্য কিছু ফজিলত রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল আশুরার অর্থাৎ মুহাররম-এর দশম দিনের ফজিলত। এখানে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতি মেনকের দৃষ্টিতে আশুরার তাৎপর্য, ফজিলত ও আমল সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল।  
ইসলামি হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম। আর পবিত্র এই মাসের ১০ তারিখে ইসলামি ইতিহাসে অনেকগুলি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তাই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। আর এই দিনটিকে আশুরা নামে অভিহিত করা হয়। কারবালার শোকাবহ ঘটনা ছাড়াও এই দিনে আরও বহু অলৌকিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।  যদিও প্রতিবছর ১০ মুহররম নিয়ে মুসলিম উম্মাহের মধ্যে একটা মতপার্থক্য দেখা যায়। আর তাহল, এই দিনে কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়। মুসলিম উম্মাহর অনেকের প্রশ্ন, এই দিনে আসলে কি হয়েছিল? ইসলামের ইতিহাসে ১০ মুহররমের  এতটা মর্যাদা কেন? আর এই বিশেষ দিনের গুরুত্বই বা কি?  
১০ মহররমের রোযা নিয়ে নবী সা.-এর হাদিস 
রাসুল (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় আসেন, তিনি সেখানকার আহলে কিতাব ইহুদিদের দিনটি রোযা রেখে উদ্যাপন করতে দেখলেন। নবীজি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই দিনে তোমরা রোযা রাখছো কেন?’ জবাবে তাঁরা বললেন, ‘এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন। আল্লাহতায়লা এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর জাতিকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (সমুদ্রে) নিমজ্জিত  করেছিলেন। 

অন্যদিকে হজরত মুসা (আ.) তাঁর অনুসারিদের নিয়ে সমুদ্রের পানি ভাগ হওয়া উন্মুক্ত রাস্তা দিয়ে নিরাপদে  অতিক্রম করেন। হজরত মুসা (আ.) এই দিনে শুকরিয়া আদায় করার জন্য রোযা রাখতেন। তাই আমরাও রোযা রাখি।’ এ কথা শুনে নবী (সা.) বললেন, ‘আমরা মুসার অধিক আপন, তোমরা ইহুদিদের মতো আচরণ কর না। তোমরা আশুরার এক দিন আগে বা এক দিন পরেও রোযা রাখো।’ (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম ও আবু দাউদ)   
যুগ যুগ ধরে আশুরা নিয়ে রয়েছে নানা কথা ও ঘটনার বর্ণনা। এ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক বই ও ডকুমেন্টরি। যা এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। শুধু কারবালার প্রান্তরে হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য আশুরা মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। বরং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে আশুরার মর্যাদার প্রকৃত ঘটনা। যে কারণে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিনে রোযা রাখার কথা বলেছেন। বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফারের কথা বলেছেন। সৃষ্টির প্রথম থেকে ১০ মুহাররম তথা আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। 
আল্লাহতায়লা এই দিনে আদম (আ.)-কে (প্রথম মানব ও নবী আ.-কে) সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে নুহ (আ.)-এর সময়ের প্লাবণ সমাপ্ত হয়। এদিন ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান। এদিন ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। এই দিনে আইয়ুব (আ.) রোগমুক্তি লাভ করেন। এই দিনে সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পান। এই দিনে ইয়াকুব (আ.) হারানো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। এই দিনে ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। আশুরার দিনে আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। 
আশুরা বলতে মুহাররম মাসের দশম দিনকে বোঝানো হয়। দিনটি বড়ই ফজিলতপূর্ণ। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুহররম' আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যেদিন আল্লাহতায়লা অনেকের তওবা কবুল করেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তওবা কবুল করবেন’ (তিরমিজি)। মুহাদ্দিসগণ একে আশুরার দিন বলেই মতামত দিয়েছেন (লাতাইফুল মাআরিফ)। 
ইহুদিদের কাছে দিনটি এতটাই মর্যাদাপূর্ণ ছিল যে, তারা তা ঈদের মতো উদ্যাপন করত। হাদিসে এসেছে, আশুরা এমন একটি দিন, যে দিনকে ইহুদিরা সম্মান করত এবং ঈদ হিসেবে গ্রহণ করত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এই দিনে রোযা রাখো।’ (মুসলিম) 
হাদিসে আরও এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, জাহিলী যুগে কুরাইশরা আশুরার দিন রোযা রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.)ও হিজরতের আগে আশুরার রোযা রাখতেন।  
মদিনায় হিজরতের পরও তিনি আশুরার রোযা রেখেছেন এবং এই রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন। এরপর রমজানের রোযা ফরজ করা হলে আশুরার রোযা নফলে পরিণত হয়। সুতরাং যার ইচ্ছা সে তা রাখতে পারে, আবার যার ইচ্ছা ছেড়ে দিতে পারে (মুয়াত্তা মালেক)।  
আশুরার রোযার ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা রাখি, তিনি আগের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (মুসলিম)। 
আশুরার দিনের রোযার সঙ্গে আগে বা পরে এক দিন রোযা রাখাও সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। ইহুদিদের সঙ্গে না মেলানোর জন্যই রাসুল (সা.) আশুরার আগের দিন বা পরের দিনও রোযা রাখার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আশুরার রোযা রাখছিলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বলছিলেন, তখন সাহাবিগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এই দিনকে তো ইহুদি-নাসারারা সম্মান করে।’ তখন নবীজি বললেন, ‘তাহলে আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও রোযা রাখব ইনশাআল্লাহ।’ কিন্তু সেই আগামী বছর আসার আগেই নবীজির ইন্তেকাল হয়ে যায় (মুসলিম)। 
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) ৯ ও ১০ তারিখে রোযা রাখার কথা বলতেন। ইমাম শাফেয়ি, আহমদ ও ইসহাক এই মত গ্রহণ করেন (তিরমিজি)। এ ছাড়া অনেকে ১০ তারিখসহ আগে এবং পরের এক দিন মিলিয়ে মোট দুটি বা আশুরার দিনসহ মোট তিনটি রোযা রাখা উত্তম মনে করেন। 
                                                                                                      তরজমা: ইমামা খাতুন