১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ তক ঔপনিবেশিক আর সম্প্রসারণবাদী শক্তি এই উপমহাদেশের মুসলমান জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। ইসলামের ‘তাহজিব-তামাদ্দুন’ (ধর্ম ও সংস্কৃতি) সাধারণ শিক্ষা– জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে ধুরন্ধর আর পরিকল্পিত হামলা। এই বিপজ্জনক আর হতাশাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে বিশ্বাসী ‘উম্মাহ’-কে ‘ডিগনিটি’-র স্তরে টেনে তোলার জন্য সমাজ-অভ্যন্তরীণ ‘আহল-ই-কলম’ (বুদ্ধিজীবী শ্রেণি)বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আর মর্যাদাশ্রিত অতি উচ্চগুণমান সম্পন্ন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এতদ্বিষয়ে তীক্ষ্ণ এক বিশ্লেষণধর্মী আলোকপাতের জন্য কলম ধরেছে, এই উপমহাদেশ বিষয়ক ইতিহাসবেত্তা আর দেশবিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের একটি উপেক্ষিত জাতিসত্ত্বার মর্যাদার অন্বেষক খাজিম আহমেদ
এমনবিধ বৃহৎ আর মহৎ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান– মাদ্রাসা– ধর্মীয় আর ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যায়তন এবং ইসলামি আদর্শে পরিচালিত সংস্থা রয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। এগুলোর মধ্যে ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ (কলকাতা)– ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া শামসুল হুদা’ (পটনা)– ‘মাদ্রাসা-ই-আজিজিয়া’ (বিহার শরীফ)– ‘মাদ্রাসা-ই-নিজামিয়া’ (হায়দরাবাদ)– ‘মাদ্রাসা-উল-উজেন’ (লখনউ) এবং ‘মাদ্রাসা-ই-নিজামিয়া’ (লখনউ)বিশেষভাবে মর্যাদাসম্পন্ন আর গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আযাদি লাভের পর কেরলে অসংখ্য আরবি ভাষাভিত্তিক মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্র-সমাজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের প্রান্তে প্রান্তে চাকুরিতে নিয়োজিত। মনে রাখতে হবে আরবি ভাষা বিশ্ব-জাহানের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। আল-কুরআন আরবি ভাষাতেই ‘নাজিল’ হয়েছে। নাগিব মাহফুজ আরবি ভাষায় সাহিত্য নির্মাণ করে ‘নোবেল লরিয়েট’-এর স্বীকৃতি আর মর্যাদা-অর্জন করেছেন। কবি আলি আহমদ সায়ীদ-এর নামও নোবেল বিজয়ীদের সম্ভাব্য তালিকায় ছিল। তিনি সিরিয়া আর লেবাননে অশেষ সম্মানিত। আরবি ভাষার ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দরবেশের কবিতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকবর্গ সবিশেষ পরিচিত।
উপরোক্ত ধর্মাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যতিরেকে অনেক উচ্চগুণমানসম্পন্ন আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্র জনকল্যাণকামী মুসলমান উদ্যোগীবর্গের দ্বারা স্থাপিত হয়েছে। এইগুলোর মধ্যে আজমগড়ের ‘দারুল-মুসান্নিফিন’ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই ‘তালিমি’ প্রতিষ্ঠানটির স্থাপনার পিছনে আবারও শিবলি নোমানির অবদান পরম শ্রদ্ধাভরে স্বীকার্য। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষী— মাওলানা শিবলি নোমানি এই প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জন অভ্যন্তরে জ্ঞানচর্চার এই বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি ‘শিবলি অ্যাকাডেমি’ নামে পরিচিত। ১৯৬৪ তে ভারত সরকার প্রভূত অর্থসাহায্য করেছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জওহরলাল নেহরুর নেক-নজর ছিল। শত শত অতীব মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ ‘শিবলি অ্যাকাডেমি’- মর্যাদা আর উঁচু অভিজাত রুচির সঙ্গে প্রকাশ করেছে– করছে।
হায়দরাবাদের ‘দাইরাত-উল-মারিক’-এর নাম এই প্রসঙ্গে অবশ্য আলোচ্য। ‘দাইরাতুল’ ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি ইতিহাস– অঙ্কশাস্ত্র আর দর্শনের ওপর ব্যাপক মূল্যবান আর বৃহদাকার গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। নিরত সেই গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়তই।
‘নদওয়াতুল মুসান্নিফিন’ (দিল্লি)প্রায় আট দশক ধরে অজস্র গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। মূলত ইতিহাস– ধর্ম-সংস্কৃতি সাহিত্য আর সর্ববিধ ইসলামি বিষয় সমূহের উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ইসলামি ‘তাহজীব’-‘তামাদ্দুন’- চর্চার জন্য গত শতকের ছয়ের দশকে লখনউতে ‘মজলিশ-ই-তাহকিকৎ ওয়া শরিয়ত-ই-ইসলাম’ নামে একটি শক্তিশালী সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। লখনউয়ের আত্মমর্যাদা সচেতন মুসলমান বিদ্বৎসমাজ আন্তরিক যত্ন এবং সতর্কতার সঙ্গে সংস্থাটি পরিচালনা করে থাকেন। নওয়াব ওয়াজিদ আলি শাহ’র শহরে আরও বিস্তর মাদ্রাসা ‘ইলম’-চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আজও বহন করে চলেছে গভীর মনযোগ সহকারে। বস্তুত জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতা-সংস্কৃতি চর্চার এই সংস্থাগুলো হিন্দুস্তানি মুসলমানদের অতি গর্বের উত্তরাধিকার। উদগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাত থেকে এই সংস্থাগুলোকে ‘চোখের মণি’র মতো যত্ন’ বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
মুসলমান ‘কওম’-এর সদস্যবর্গ দ্বারা পরিচালিত ‘আঞ্জুমান-ই-তারিকি উর্দু-এ-হিন্দ’ উন্নত শিক্ষা-সভ্যতা চর্চার একটি সম্মাননীয় প্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে– উর্দু ভাষার প্রগতি আর উন্নতি সাধন। উর্দু ভাষাকে ‘The Fourth Language of Islam’ বলা হয়ে থাকে। ‘আঞ্জুমান’ হরওয়াক্ত উচ্চমানের উর্দুগ্রন্থ প্রকাশ করে সুরুচি আর দক্ষ পরিচয় রেখেছে। এই সংস্থাটি ভারত সরকারের আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে উর্দু ভাষায় ইসলামের ওপর বিস্তর মূল্যবান ‘কিতাব’ রয়েছে। শিখ ধর্মের ওপর নির্ভর করে উর্দু ভাষায় বহু গ্রন্থ রয়েছে। সেই সব পবিত্র গ্রন্থের বিষয় নিয়ে বহু সময় ‘মাভেরিক এডিটর’– লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ‘দ্য টেলিগ্রাফ’– ‘দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’ নামক সংবাদমাধ্যমে আলোচনা করেছেন। উত্তর আর উত্তর-পশ্চিম ভারতের লক্ষ লক্ষ হিন্দুধর্মী অভিজাত শ্রেণি উর্দু ভাষায় কথা বলে স্বস্তি আর সম্মানিতবোধ করেন। প্রেমচন্দ (প্রেমচাঁদ) আর কৃষ্ণচন্দর উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় সৃষ্টিশীল লেখক। ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের জীবনীকার হচ্ছেন ড. সচ্চিদানন্দ। এতদ্ সত্ত্বেও হাল আমলে উৎকট আর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতাবাদী শাসকগোষ্ঠী উর্দু ভাষাকে উপেক্ষার নজরে রেখেছে। এত জীবন্ত ভাষা মরে না। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। সে আলোচনার মওকা এখানে নেই।
দরবেশ-বাদশাহ– পিউরিটান আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মুসলমানরা মহাদুর্যোগের সম্মুখীন হল। রাজনৈতিক– সমাজ-আর্থ এবং শিক্ষাগত দিক দিয়ে অন্যান্য ভারতীয়দের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল। তেমন সময়ে এই উপমহাদেশের মুসলমান জাগরণের ‘পায়ওনিয়ার’-স্যার সৈয়দ আহমদ খান স্থাপন করেছিলেন ‘মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ’ (১৮৭৫)– বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান পরিষদ (১৮৬৪)– অধিকার আদায়ের জন্য আধুনিক উর্দু সংবাদপত্র ‘তাহজিব-উল্-আখলাক (১৮৭০)’। স্মতর্ব্য– আধুনিকতা আর যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত কলেজটি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ‘আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’-এ পরিণত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কলেজটি গড়ে উঠেছিল ‘অক্সফোর্ড’ এবং কেমব্রিজের অনুকরণে।
এই উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা– আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয় আর অগ্রগতির জন্য ‘আলিগড় আন্দোলন’-এর মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহমদ খান যা করেছিলেন তাঁর তুলনা মেলে মহাত্মা রামমোহন-এর কর্মধারার মধ্যে। স্যার সৈয়দ অধ্যক্ষ থিয়োডর বেকের পরামর্শে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষণের জন্য স্থাপন করেন ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘মহমেডান অ্যালো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব আপার ইন্ডিয়া’ নামক দু’টি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ড. বিপনচন্দ্র মনে করেন যে, তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের জীবনের একমাত্র ‘মটো’ ছিল যেকোনও উপায়ে মুসলমান সমাজের উন্নয়ন। (দেখুন– ‘মডার্ন ইন্ডিয়া– নিউ দিল্লি– ১৯৭১— উপরন্তু দেখুন– বিপনচন্দ্র– ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেনডেন্স’– পেঙ্গুইন বুকস পৃঃ ৪১৪– এস আবিদ হাসান– ‘দ্য ডেস্টিনি অব ইন্ডিয়ান মুসলিমস’– বোম্বে– ১৯৬৫– পৃঃ ২৪– সৈয়দ আহমদ খান– ‘রাইটিংস অ্যান্ড স্পীচেস’– সম্পাদকঃ শান মুহাম্মদ– বোম্বে-১৯৭২)।
……………………