হাইলাইটসঃ এক সময় বাংলার শাসনকার্য পরিচালিত হত সুবে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে। রাজধানীর নাম হারালেও গৌড়ের স্থাপত্য ও কারুকার্য আজও সুলতানী দরবারের সংস্কৃতিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। ধ্বংসের মাঝেও অনুপম জীবনের স্মৃতি জাগ্রত করা সেইসব স্থাপত্যের কয়েকটি।
১। দ্বাদশ শতক থেকে ষষ্টদশ শতক পর্যন্ত সুবে বাংলার রাজধানী ছিল মালদা জেলার গৌড়। চার শতক ধরে গৌড় দেখেছে বহু রাজত্বের উত্থান ও পতন। ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ আজও স্মরণ করিয়ে দেয় সুদৃশ্য গ্রামীণ স্থাপত্য-ভাস্কর্যকে যেমন বাইশ-গজি প্রাচীর (ছবিতে দেখা যাচ্ছে)। এককালে একে বলা হত গৌড়ের রক্ষাকবচ দুর্গ। এই স্থাপত্য বর্তমানে ক্রমশ মলিন ধুলোবালিতে পরিণত হচ্ছে । এই প্রাচীরের উচ্চতা ৬৬ ফুট বা ২২ গজ। সে কারণেই এর নাম হয়েছে ‘বাইশ-গজি’। এটি নির্মাণ করেছিলেন বরবাক শাহ। ১৪৫৯-১৪৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সুবে বাংলার সুলতান।
২। বড় সোনা মসজিদ। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এটি অন্যতম বৃহত্তম স্থাপত্য। ১৫২৬ সালে এটির স্থাপনা করেছিলেন নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ। এই মসজিদে এক সময় ৪৪টি গম্বুজ ছিল, যার মধ্যে বর্তমানে ১১টি টিকে আছে। বড় সোনা মসজিদের আর এক নাম বারো দুয়ারি, কারণ এর ১২টি দরজা রয়েছে। মজার বিষয় হল, বারো দুয়ারি নাম হওয়া সত্ত্বেও এই মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে মোট ১১টি বিশাল দরজা।
৩। গৌড়ের দুর্গ শহরে আগত দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় দুটি সুসজ্জিত, অলংকৃত ও চিত্রিত স্তম্ভ। বড় সোনা মসজিদের পাথুরে স্তম্ভের সঙ্গে এই নির্মাণকাজের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এই স্তম্ভগুলিও এক সময় মসজিদের অংশ ছিল। তবে কেউ জানে না, কবে ও কেন এগুলি মূল স্থান থেকে সরানো হয়েছিল। সম্ভবত, হাতি বাঁধার জন্য এগুলি পরে ব্যবহৃত হত এবং স্থানীয়রা এর নাম দেয় ‘হাতি বাঁধা স্তম্ভ’।
৪। প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে রামকেলি। এটি মহাপ্রভু চৈতন্যকে উৎসর্গ করা একটি মঠ। এই ঐতিহাসিক শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র ধ্বংসাবশেষ ও স্মৃতিসৌধের মধ্যে এটাই একমাত্র সজীব হিন্দু ধর্মীয় স্থল। এখানেই সুলতান হুসেন শাহের দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রূপ ও সনাতন গোস্বামী ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন চৈতন্যের। চৈতন্যের একটি মূর্তি ও একটি ছোট মন্দির আজও তাদের প্রথম সাক্ষাতের চিহ্ন বহন করে। এখন, রামকেলি আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে।
৫। গৌড়ের দুর্গের যে তিনটি তোরণ আজও টিকে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল দাখিল দরওয়াজা। এটি সালামি দরওয়াজা নামেও পরিচিত। দুর্গে যখন কোনও বিশিষ্ট অতিথি আসতেন তখন এখান থেকে তাঁকে বন্দুক ছুঁড়ে স্যালুট জানানো হত, তাই এমন নাম। এই ইমারতের মধ্যে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলি মিশ্রিত হয়েছে এবং সূক্ষ্ম টেরাকোটার কাজও রয়েছে এতে। রয়েছে ফ্লোরাল ও জ্যামিতিক নকশা। দেওয়ালকে এই নকশা দিয়েই সাজানো হয়েছে। ইঁট দিয়ে নির্মিত এই তোরণ এবং চার কোণে রয়েছে চারটি মিনার।
৬।পঞ্চদশ শতকে সাইফুদ্দিন ফিরুজ শাহ নির্মাণ করেছিলেন ফিরোজ মিনার। পাঁচ তলা বিশিষ্ট এটি এক বিজয়-স্তম্ভ। বরবাক শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করার পর এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই স্মৃতি আজও বহন করছে এই ইমারত। এর উচ্চতা ৮৫ ফুট। এক সময় বিশালাকায় গম্বুজ ছিল যার উপর পরে সমতল ছাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৭। রাজ দরবারের প্রবেশের জন্য ছিল ‘লুকোচুরি দরওয়াজা’। এটি শাহি দরওয়াজা নামেও পরিচিত। ত্রিতল বিশিষ্ট এই ইমারতে রয়েছে প্রহরা কক্ষ ও ড্রাম ঘর। ১৬৫৫ সালে এটি স্থাপিত হয়েছিল। তবে, এই তোরণে আজও সূক্ষ্ম পলেস্তারা-কর্মের চিহ্ন রয়ে গেছে। এই তোরণের সমগ্র বাইরের অংশটা এক কালে আবৃত ছিল রঙিন মিনে করা এনামেলের টালি দিয়ে।
৮। তাঁতিপুরা মসজিদের নামটি এসেছে বাংলা শব্দ ‘তাঁতি’ থেকে। ১৪৭৪-১৪৮০ সালে মধ্যে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এই মসজিদের সঙ্গে স্থানীয় তাঁতি সম্প্রদায়ের গভীর যোগাযোগ ছিল। তাঁতিপুরা মসজিদে সুন্দর টেরাকোটার কাজ রয়েছে। গৌড়ে যতগুলি সুদৃশ্য মসজিদ রয়েছে তার মধ্যে এই মসজিদের টেরাকোটার কাজ বিখ্যাত। কিন্তু সময় বড় নির্মম। এক সময় ১১০টি গম্বুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত যেখানে আজ সেখানে একটাও গম্বুজ নেই। সবই এখন ইতিহাসের কোলর আশ্রয় নেওয়া স্মৃতি। পূর্ব দিকের দেওয়ালের একটা বড় অংশও ভেঙে পড়েছে।
৯। চামকাটি মসজিদের এমন নাম হল কেন তা নিয়ে নানা রকম তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। কেউ মনে করেন, ‘চাম কাটি’ এসেছে ‘চামড়া কাটা’ থেকে। মনে করা হোয মুসলিম ‘লেদার’ শ্রমিকদের দেওয়া এই নাম। আবার অনেকের বিশ্বাস, মসজিদের নাম ‘চামকাথি’ থেকে এসেছে যার অর্থ হল সংকীর্ণ প্রবেশ পথ। ১৪৭৫ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ।
১০। ২০০৩ সালে বল্লাল বাটি খনন করা হয়েছিল এবং তারপর থেকে গৌড়ের ধংসাবশেষের তালিকায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে রয়ে গিয়েছে। এই ইমারতের নির্মাণ-সাল বা তারিখ সম্বন্ধে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। কারও কারও মতে, সেন বংশের রাজপ্রাসাদের অংশ এটি। আবার অনেকে মনে করেন, পাল সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ স্তূপ আসলে এই ধ্বংসাবশেষ।