সেখ কুতুবউদ্দিনঃ রবিবার পার্ক সার্কাস হজ হাউসে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম শেূ নুরুল হক-এর স্মরণসভার আয়োজন করে সংগঠনটি। এদিনের স্মরণসভায় মরহুম নুরুল হকের জীবন ও আদর্শ তুলে ধরেন উপস্থিত বিশিষ্টরা।
মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সম্পাদক মরহুম নুরুল হকের রুহের মাগফিলাত কামনা করে পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক ও প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান বলেন– মরহুম নুরুল হক এক স্বর্ণালী অধ্যায়। তিনি বামফ্রন্ট আমলে মাদ্রাসা অনুমোদন ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সম্পর্কে আমার একটি ভুল ধারণা ছিল যে– তিনি সিপিএম দলের ঘনিষ্ঠ এবং তাদের হয়েই কাজ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি উপলব্ধি করেছি– বাম শাসন আমলে এছাড়া উপায় ছিল না। বামফ্রন্টের শক্তপোক্ত বাঁধনের মধ্যে তাদের সহযোগিতা নিয়েই তাঁকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এটা তাঁর এক বড় কৃতিত্ব।
মুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ হাসান ইমরান আরও বলেন– মুসলিমদের ২ শতাংশ চাকরি ছিল না। সাচার কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়– বামফ্রন্ট আমলে মুসলিম প্রধান ১ হাজার গ্রামে একটিও প্রাথমিক স্কুল ছিল না। দক্ষিণ দিনাজপুর– উত্তর দিনাজপুর– বাঁকুড়া– পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলার মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয় ছিল। তিনি বলেন– পঠনপাঠনে রাজ্যের জুনিয়র– হাই ও সিনিয়র মাদ্রাসাগুলি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার অগ্রগতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আল আমীন মিশন কাজ করছে। ফলে গত ১০-১৫ বছরে বাংলায় মুসলিমদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সামগ্রিক না হলেও ব্যাপক উন্নতি করেছে। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে যদি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ১৪-১৫ জন ছাত্র সুযোগ পেত– তাহলে আমরা ভাবতাম এবছর মেডিক্যালে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা দরুণ ফলাফল করেছে। আজ আল্লাহর রহমতে আল আমীন মিশন ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে কম করে ৮০০-৯০০ ছাত্র-ছাত্রী মেডিক্যাল কলেজে স্থান পাচ্ছে। আহমদ হাসান ইমরান বলেন– আল আমীন মিশনের এই নুরুল ইসলাম সাহেব ও তাঁর সহযোগীরা এ বিষয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর ও সহযোগীদের প্রচেষ্টায় এখন মাদ্রাসা থেকেও ছেলে-মেয়েরা ডাক্তারি পড়তে সুযোগ পেয়েছেন।
ব্রিটিশ আমল থেকে এবং পরে শেরে বাংলা ফজলুল হক– সৈয়দ শামসুল হুদা প্রমুখ মাদ্রাসা তৈরি করে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের মানসম্পন্ন ও ইসলামী আবহে পড়াশোনা করে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেন। বর্তমানে মাদ্রাসায় মেয়েরা অধিক সংখ্যায় ভর্তি হচ্ছে। এতে মাদ্রাসাগুলির বড় ভূমিকা রয়েছে। স্কুলের মতোই হাইমাদ্রাসায় সব বিষয়ে পড়ানো হয়। শিক্ষকদের বেতনও সমান। হিন্দু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরাও মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছেন। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ বিহারের মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেছিলেন।
মাদ্রাসায় নতুন নিয়োগ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য– বর্তমানে মাদ্রাসায় চাকরির ক্ষেত্রে কোনও সংরক্ষণ নেই। এখন দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগে মুসলিমদের থেকে হিন্দুরা বেশি সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু এই বিষয়ে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হলে– কমিশন তথ্য দিতে রাজি নয়। বহু হাইমাদ্রাসায় হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকারা হেড মাস্টার হিসেবেও নিয়োগ পাচ্ছেন।
আহমদ হাসান ইমরান আরও বলেন– বর্তমানে বিজেপি সরকার অসমে মাদ্রাসাগুলি বন্ধ করেছে। অসমের মু্যূমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার যুক্তি– সরকারি টাকায় কেন আরবি ও ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হবে। কিন্তু সম্প্রতি বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্টৃñতে বিএ ও এমএ পাঠক্রম চালু করেছে। এটাও কিন্তু সরকারি টাকাতেই হচ্ছে।
আল আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক জনাব এম নুরুল ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়ার শিক্ষার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন– দুনিয়ার শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিকতা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মাদ্রাসা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য– খুলতপুর হাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছি। মাদ্রাসাকে অবলম্বন ও অনুসরণ করেই আল আমীন মিশনকে প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি বলেন– মরহুম নুরুল হক সাহেব আমাকে রামকৃষ্ণের ও বিবেকানন্দের কথা শোনাতেন। আমি মু? হয়ে তাঁর কথা শুনতাম। তখন চেয়েছিলাম– তাদেরও অনুকরণ করব। নুরুল ইসলাম আরও বলেন– শিক্ষক ও শিক্ষকদরদী হিসেবে মরহুম নুরুল হক পরিচিত ছিলেন। আল আমীনের সঙ্গেও হার্দিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা। মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নতিতে তাঁর ভূমিকা ইতিহাস মনে রাখবে।
এ দিনের স্মরণ সভায় এসে সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন– স্কুল শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সমানভাবে ভূমিকা পালন করে। মাদ্রাসার শিক্ষকদের স্বার্থে কোনও কোনও সময় সরকারের সঙ্গে আপোষ করা প্রয়োজন। সেটা করে দেখিয়ে ছিলেন মরহুম নুরুল হক। শিক্ষক নেতা আবু সুফিয়ান পাইক– মাদ্রাসা শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে এদিন আল আমীন ফাউন্ডেশনের কর্ণধার মোতালেব আলি সরদার মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণণা করেন।
এদিনের স্মরণ সভায় উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ তাহেরুল হক– সহ সভাপতি শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত নুর নবি জমাদার– সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ সরদার– মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম– আইনজীবী মুহাম্মদ আসরাফুল হক– আজিজুল হক প্রমুখ।
১৯৪৭ সালে হুগলির দাদপুরের বলদপুরে জন্ম মরহুম নুরুল হকের। গ্রামে পাঠ শেষ করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন। মাদ্রাসার শিক্ষকতা ও পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সম্পাদক পদে ছিলেন ৪৮ বছর। ২০২০ সালের ১ মে ৭৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। নুরুল হক সাহেবের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করাই পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির একমাত্র লক্ষ্য বলে সমিতির নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন।