পুবের কলম প্রতিবেদক, ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বা বেগম রোকেয়ার জন্ম ও ইন্তেকালের দিন। ১৯৩২ সালের এ দিনেই ৫২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ দিন বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নারী জাগরণের অগ্রপথিক রোকেয়ার স্মরণে নানান অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকালে দৈনিক ‘পুবের কলম– বঙ্গীয় সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মঞ্চ ও মুসলিম কাউন্সিল অফ বেঙ্গল-এর তরফেও রোকেয়ার ১৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জন্মতিথিতে অনুষ্ঠিত হল বিশেষ আলোচনাসভা। সেই মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে রোকেয়া সম্পর্কে উঠে আসে নানান বিষয়। এ দিন বিশিষ্টরা দাবি তোলেন– রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দিনটিকে ‘নারীশিক্ষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে।
এ দিন কড়েয়া রোডের ইয়ং হরাইজোন স্কুলের চতুর্থ তলে রোকেয়া স্মরণ অনুষ্ঠান পীরজাদা মোহেবুল্লাহ হোসাইনির পবিত্র কুরআন পাঠের মাধ্যমে শুরু ও দোয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এক বিশেষ মুহূর্তে কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ কবিতা আবৃত্তি করেন ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজের অধ্যাপক অরুণিমা দত্ত।
প্রসঙ্গত– ইসলাম ধর্ম নারীকে অনেক মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু এক সময় সমাজে কুসংস্কার প্রবেশ করে– ফলে নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখা হত। শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ ছিল না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বেগম রোকেয়া সমাজকে দিশা দেখিয়েছিলেন। এ দিন সেই দিকটির উপর আলোকপাত করেন ‘পুবের কলম’-এর সম্পাদক ও প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান।
আহমদ হাসান ইমরান বলেন– রোকেয়া মোটেও নারীবাদী ছিলেন না। তিনি সমগ্র সমাজে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি পুরোপুরি ইসলামকে মেনে চলতেন। শীতের সময় ফযর নামায-এর জন্য অযু করার পর জায়-নামায-এ বসেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন রোকেয়া। তিনি আরও বলেন– ব্রিটিশ আমলে সমাজে অনেক কুসংস্কার ঢুকে গিয়েছিল– মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলা ভুলে গিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হত। বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তারের কাজ শুরু করেন। বেগম রোকেয়ার শিক্ষার্থীরা অনেকেই বাংলাদেশে প্রফেসর ও মন্ত্রী হয়েছিলেন।
ইমরান উল্লেখ করেন– আগে রোকেয়াকে নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি– ১৯৮৪ সালে নতুন করে চর্চা শুরু হয়। আনন্দবাজারে গৌরী আয়ুবের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল এবং কলম-এ রোকেয়ার জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত লেখা প্রকাশিত হয়। রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম সেই লেখা নিয়ে বই প্রকাশ করবে বলেও জানান ইমরান। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন– সোদপুরের এক বাগান বাড়িতে রোকেয়াকে সমাহিত করা হয়েছিল– কিন্তু আজ সেই কবরের অস্তিত্ব নেই। এটা আমাদের জন্য জঘন্য অপরাধ।
এ দিন আহমদ হাসান ইমরান দাবি করেন– বেগম রোকেয়ার জন্ম ও ইন্তেকালের দিনটিকে ‘নারীশিক্ষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে এবং পালন করতে হবে।
এ দিন বঙ্গীয় সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সভাপতি ও অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক ওয়ায়েজুল হক রোকেয়া ও মুসলিম সমাজ সম্পর্কে অমুসলিমদের না জানার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন– ইসলামের প্রকৃত আদর্শ না জানার ফলে অন্যদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়। এমনকী শিক্ষিত মানুষও মুসলিমদের সম্পর্কে মনে করেন যে– এরা নারীকে স্বাধীনতা দেয় না। আদতে ইসলাম যে নারী অর্থাৎ মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত রেখেছে তা অনেকেই জানেন না।
অন্য এক প্রসঙ্গে ওয়ায়েজুল হক বলেন– কোনও মহান ব্যক্তিত্ব বা মনীষীকে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট দিনে স্মরণ করলে হবে না বরং তাঁর শিক্ষা ও চেতনাকে মননে গেঁথে নিতে হবে। তাঁর আদর্শে চলতে হবে– তবেই যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হবে। এ দিন ওয়ায়েজুক হকও দাবি তোলেন– বেগম রোকেয়ার নামে অন্তত একটি মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করতে হবে। সরকারের তরফে দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে। তিনি রাজ্যের শিক্ষা দফতর ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি তুলে ধরার কথাও বলেন।
এ দিন রোকেয়ার কবিতা ‘সোনার পিঞ্জরে ধরে রেখো না আমায়/ উড়িতে দাও দূর নীলিমায়’ উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন বিশিষ্ট শিক্ষক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন– ‘কুরআনের প্রথম শব্দ ইকরা– মানে ‘পড়– এই বাণীকে অন্তরের অন্তঃস্থলে গেঁথে নিয়েছিলেন রোকেয়া। সেই সময় মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চল ছিল না। তারপরও দাদাদের সাহায্যে পড়াশোনা শিখেছিলেন তিনি। বিয়ে হবার পর তাঁর স্বপ্ন সফল হয়। তাঁর লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ এ তিনি কল্পনা করেছিলেন নারীরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী– পশ্চিমবঙ্গেও নারী মুখ্যমন্ত্রী। আমরা এগোচ্ছি– তবে রোকেয়ার শিক্ষা ও চেতনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর মোল্লা বলেন– বাংলাদেশে রোকেয়ার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে– আমাদের দেশে তা নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক। বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে– নারী সমাজকে জাগাতে না পারলে সমাজের প্রকৃত বিকাশ হবে না– তাই চালু করেছিলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল।
অন্যদিকে তথ্যচিত্র নির্মাতা মুজিবর রহমান বলেন– রোকেয়া যে স্পিরিট নিয়ে কাজ করেছেন এবং সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের মধ্যে সেই চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। মুসলিম মেয়েরা আগের তুলনায় অনেকটা এগিয়েছে– তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন মুজিবর রহমান।
এ দিনের অনুষ্ঠানে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিরাত-এর আবু সিদ্দিক খান– ডা. হাসান জামিল– ডা. জামান– শেখ হান্নান প্রমুখ।