পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ
‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার
ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা
ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার।’ জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের এই গানই যেন আজ বাজছে গোটা দেশে। একের পর এক ছন্দপতন। গোটা দেশ শোকে আবহে মূহ্যমান। এখনও সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের স্মৃতিতে ডুবে আছে গোটা দেশের মানুষ। সেই দুঃখের আবহের মধ্যে গতকাল ফের বিষাদের সুর বেজে উঠল রাজ্যে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ সুর লোকের মায়া কাটিয়ে প্রিয় বন্ধু লতার কাছে চলে গেলেন গীতশ্রী। আর সেই খবরের রেশের মধ্যেই ফের আজ সকাল বয়ে নিয়ে এল আরও একটি দুঃসংবাদ। প্রয়াত হলেন ডিস্কো কিং, সুরকার, বিশিষ্ট শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী। মুম্বইয়ে জুহুর কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন এইক কিংবদন্তী। তিন লেজেন্ড-এর এই প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা দেশে। শোকজ্ঞাপণ করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যের কিংবদন্তী থেকে একাধিক ব্যক্তিত্ব। শোকে পাথর সাধারণ মানুষ। রঙিন- সাদা-কালো সর্বক্ষেত্রেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কিংবদন্তীরা।
৯০ বছর বয়সে চলে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বয়স নব্বই। আর লতা চলে গেলেন ৯২ বছর বয়সে। ১৯৫০ সালে বম্বে যান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শচীন দেব বর্মণের সুরে গান করার জন্যই। কলকাতা থেকে যোগসূত্র আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রথম শচীন দেব বর্মণের সুরে নয় গান গাইলেন অনিল বিশ্বাসের সুরে। ছবির নাম ‘তরানা’। এই ছবিতেই গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। এই ছবির সূত্র ধরেই দুই গায়িকার পরিচয়। ‘বোল পাপিহে বোল রে’ এই গান এক সঙ্গে গেয়েছেন লতা-সন্ধ্যা। কিছুদিন পর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতে তাঁর মা যান বম্বে। সে সময় লতা প্রায় চলে আসতেন। মায়ের হাতের রান্না খেতে। লতা শুনিয়েছেন তাঁর জীবনের লড়াইয়ের গল্প। দুই বন্ধুর লড়াইয়ে গল্প দুজনের মধ্যে ভালোবাসার জন্ম দেয়।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশে জন্ম সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের। খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবনে চলা। খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরেন লতা। ভাই-বোনের প্রকৃত অভিভাবক হয়ে ওয়ে ওঠেন সুর সম্রাজ্ঞী। শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তার। বাবা চাইতেন ও শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হল, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে এল সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। ৫ বছর বয়সে বাবার পরিচালিত গীতি-নাট্যে অভিনয় করেন।
১৯৪১ সালে রেডিওতে দুটি গান রেকর্ড করেন, বাবার মৃত্যুর পর পেশা জীবনে পা রাখেন। ১৩ বছর বয়সে মারাঠি গানের রেকর্ড হয়, কিন্তু সে গান সিনেমা থেকে বাদ যায়। তাঁর প্রথম হিন্দি গান মারাঠি ‘জগভাউ’ নামক ছবিতে। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘আপ কি সেবা মে’ প্রথম হিন্দি গান গেয়েছেন তিনি। তারপর ১৯৪৮এ প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়-এর ছবি ‘শহিদ’ ছবিতে তিনি সুযোগ পান এবং মজবুর সিনেমায় ‘দিল মেরা তোড়া’ গানে তিনি বিশেষ জনপ্রিয়তা পান। বাংলা ভাষায় ২০০টি বেশি গান গেয়েছেন লতা। ১৫ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন হিন্দিতে। ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন সুর সম্রাজ্ঞী। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সুর লোকের মায়া ত্যাগ করে অমৃতলোকে যাত্রা করেন কোকিলকন্ঠী, নাইটিঙ্গেল লতা মঙ্গেশকর। আর তার ঠিক নয় দিন পরে চলে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত হলেও তবুও তার বেশিরভাগ কাজ বাংলা আধুনিক গানে। ১৯৫০ সালে তারানা চলচ্চিত্রে একটি গান দিয়ে মুম্বইতে তার হিন্দি গান গাওয়া শুরু হয়। তিনি ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান গেয়েছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি তার কলকাতা শহরের বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে ‘জয় জয়ন্তী’ এবং ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গান দুটি হল – ‘আমাদের ছুটি ছুটি’ এবং ‘ওরে সকল সোনা মলিন হল’। এছাড়াও ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
এক অন্য ঘরানা গান, সুর উপহার দিয়ে মানুষের মনে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। ১৯৮০’র দশকের চলচ্চিত্র বিশেষ করে ডিস্কো ড্যান্সার, নমক হালাল এবং শরাবী’র মতো বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি জনপ্রিয় ওঠেন।
বাপ্পি লাহিড়ি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সমৃদ্ধ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম আলোকেশ বাপ্পী লাহিড়ি। বাবা অপরেশ লাহিড়ী ছিলেন একজন বাংলা সঙ্গীতের জনপ্রিয় গায়ক। মা বাঁশরী লাহিড়িও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়িকা। তিন বছর বয়সেই তবলা বাজাতে শুরু করেন। পিতা-মাতার সান্নিধ্যে থেকেই তিনি সঙ্গীতকলায় হাতে খড়ি ও প্রশিক্ষণ নেন।
অসম্ভব কিছু নয় শিরোনামে মোহাম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারের সঙ্গেও দ্বৈত সঙ্গীতে অংশ নেন। তার পরের চলচ্চিত্র হিসেবে চালতে চালতে
ছবিটির গানও দর্শক-শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রবিকান্ত নাগাইচের সুরক্ষা ছবিতে গান গেয়ে সঙ্গীতকার হিসেবে জনপ্রিয়তা পান।
মিঠুন চক্রবর্তী’র ডিস্কো নাচের চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০’র দশকে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপ্পী লাহিড়ী একসঙ্গে বেশ কিছু ভারতীয় ডিস্কো চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এছাড়াও, তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালিত অনেক হিন্দী চলচ্চিত্রের গানে অংশ নিয়েছেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি নিজেকে ‘ডিস্কো কিং’ নামে পরিচিতি লাভে সমর্থ হন। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ১৯৯০’র দশকে দূরে সরে যান তিনি। প্রকাশ মেহরা’র ‘দালাল’ ছবিতে স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে আসেন।