৩০ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যুদ্ধে কি জড়িয়ে পড়বে ইরান ও ইসরাইল?

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, শনিবার
  • / 9

ইরানের দাবি– গবেষণার জন্য শান্তির লক্ষ্যে তাদের পরমাণু প্রকল্প। কিন্তু ইসরাইল মনে করছে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে ইরান। ইসরাইল-আমেরিকার অধিকার থাকলেও ইরানকে কোনও মতেই পরণু অস্ত্র তৈরির অধিকার দেওয়া যাবে না। জটিলতা কাটাতে আলোচনায় বসেছে পাঁচ শক্তিধর দেশ। এই নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন মুহাম্মদ আলাউদ্দিন। 

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ২৭ ডিসেম্বর অষ্টমবারের জন্য বৈঠকে বসছে ইরান ও বিশ্বের পাঁচটি শক্তিশালী দেশ। বৈঠকে থাকছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিও। ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ব্রিটেন– চিন– রাশিয়া– জার্মানী– ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

২০১৫ সালের এপ্রিলে বারাক ওবামার শাসনকালে ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে একটি সংযুক্ত কার্যপ্রণালীতে স্বাক্ষর করে আমেরিকা-সহ ছয়টি দেশ। পরে ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন এবং ইরানের উপর বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়।

ইরানকে ভাতে মারার চেষ্টা করা হলেও ইরান সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়ে ইসরাইল-আমেরিকাকে চোখ রাঙানোর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। সেই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি ইরানকে নিয়ে পুনরায় সংশোধিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই বছর নভেম্বরের শেষ ও ডিসেম্বরের প্রথম থেকে সাতবার বৈঠক হয় ভিয়েনায়। আমেরিকার চাপানো প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়া না হলে ইরান নতুন চুক্তিতে রাজি নয়– আর বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলিও চাইছে না মধ্যপ্রাচ্যে এখনই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাক। তাই ২৭ ডিসেম্বর অষ্টম ভিয়েনা বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব।

যুযুধান দুই পক্ষই রীতিমতো যুদ্ধের মহড়া শুরু করে দিয়েছে বৈঠকে বসার আগেই। একে অপরকে চাপে ফেলার জন্যই হোক– কিংবা সত্যকার যুদ্ধ বাধানোর মাস্টার প্ল্যান বানিয়ে রাখা হোক— ভিয়েনার বাইরেও জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। লড়াইয়ের পূর্বাভাস মনে হতে পারে যেসব বিষয়গুলি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

১) আমেরিকার নিরাপত্তা উপদেষ্টা গিয়েছেন তেলআবিবে– ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে। আলোচ্য বিষয় ইরানের হুমকি ও ভিয়েনা বৈঠক।

২) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এই সপ্তাহে এলেন আরব আমীরশাহী। নাকতালি বেনেট ও যুবরাজ শাইখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বৈঠক করেন ইরান নিয়েও। আমীরশাহী প্রতিনিধি পাঠিয়েছে তেহরানেও।

৩) ইরাকের প্রতিনিধি সউদি আরব ও ইরানকে নিয়ে তৃতীয় দফার বৈঠকের আয়োজন করেছেন বাগদাদে।

৪) আমেরিকা ঘোষণা দিয়েছে আর সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। ইরান ইচ্ছা করে বিলম্ব করছে। এবার ইসপার-উসপার সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

৫) ইরান প্রকাশ্যে জানাল– তাদের পরমাণু প্রকল্পের উপর আঘাত এলে তেলআবিব ও হাইফাকে নির্মূল করে দেওয়া হবে মানচিত্র থেকে।

৬) আমেরিকার হার্ড-লাইনার নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন– বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে এনে দেশের মর্যাদা হানি করেছে। তাই এবার ইরানের কাছে মাথা নত করা এবং ইরানের শর্ত মেনে নেওয়া যাবে না।

৭) ‘তেহরান টাইমস’ তাদের দৈনিক কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ম্যাপ এঁকে জানিয়ে দিয়েছে ইসরাইলের কোন কোন শহর ও সামরিক ঘাঁটি এবং আরব দেশে কোন কোন মার্কিন সেনা ঘাঁটিগুলি তাদের ব্যালাস্টিক মিসাইলের পাল্লার মধ্যে রয়েছে।

৮) ইরানকে আঘাত করার জন্য অস্ত্রবাবদ ১.৫ বিলিয়ন ডলার সম্প্রতি বরাদ্দ করেছে ইসরাইল।

৯) আমেরিকা ও ইসরাইলের সেনাবাহিনী শক্তি পরীক্ষার জন্য মকড্রিল করেছে কয়েকদিন আগে।

আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এখন জোর চর্চা চলছে অষ্টমবারের ভিয়েনা বৈঠক নিষ্ফলা হলে ইরানের সঙ্গে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলি কি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? এবার কি আরও কয়েকটি মুসলিম দেশ বরবাদির তালিকায় এসে যাবে? আন্তর্জাতিক সমর বিশেষজ্ঞদের অভিমত– ২০১৮ সালে ট্রাম্প জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন বা জেকপোয়া থেকে সরে আসার পর ইরান ভিতরে ভিতরে পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে অনেক এগিয়ে গেছে। সমরাস্ত্রে শক্তিধর দেশের তালিকায় ২০২১ সালে ইরান ১৪ নম্বরে– সেখানে ইসরাইল রয়েছে ২০-তে। ইরানের মেজর জেনারেল গুলাম আলি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন– তাদের ‘নেজাত’ মিসাইল মুহূর্তের মধ্যেই ইসরাইলকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। পরমাণু অস্ত্র লাগবে না– মিসাইলেই শেষ হয়ে যাবে ইসরাইল। সেনা প্রধান মুহাম্মদ বাঘারি হুমকি দিয়েছেন— ইরানের উপর সামান্যতম আঘাত এলেও পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য তিনটি বাহিনী তৈরি রয়েছে। একাধিক টার্গেটে হামলা করার জন্য তৈরি তারা।

অপরদিকে– ইসরাইল মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের সেনাবাহিনী কীভাবে সাদ্দাম হুসেনের জামানায় ইরাকের পরমাণু প্রকল্প ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাগোষ্ঠী ‘হামাস’ কিছুটা সফল হলেও ইসরাইল সম্পূর্ণ আয়রন ডোমের ভিতরে এখন নিরাপদ অবস্থায় চলে এসেছে। পাল্টা হুমকি দিয়েছে ইসরাইল— আমেরিকার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় নামার দুঃসাহস যেন না দেখায় ইরান।

জেকপোয়ায় কী কী শর্ত ছিল? ইরান পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ করেছে এই খবর চাউর হতেই সবচেয়ে বেশি ভীত হয় ইসরাইল। আয়াতুল্লাহদের ইরান ইসরাইলের কব্জা থেকে ফিলিস্তিন– জেরুসালেম ও মসজিদুল আকসা মুক্ত করার ডাক দেয় শুরু থেকেই। আমেরিকা ও ইসরাইল ইরানের কাছে দুশমন নাম্বার ওয়ান। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রধান এজেন্ডা ছিল আল আকসা উদ্ধার। তাই ইরানকে আন্তর্জাতিক চুক্তির শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলার জন্যই এই চুক্তি। যাতে ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাতে না পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ–  নজরদারি– ইন্সপেকশন রিপোর্ট গ্রহণ পাহারাদারি সব ধরনের খবরদারি করা হয় এই চুক্তিতে। তা সত্ত্বেও ইরান শান্তির উদ্দেশ্যে পরমাণু প্রকল্প জারি রাখে নজরদারির মধ্যেই।

অপরদিকে– ইসরাইলের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তোলেনি। ইসরাইল এখনও স্বীকার করেনি যে– তারা পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে কিংবা অস্বীকারও করেনি। রাষ্ট্রসংঘে প্রস্তাব আনা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যকে পরমাণু মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হোক। কিন্তু সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে ইসরাইল। আর ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে সন্ত্রাস বৃদ্ধির অজুহাত তোলা হয়। জেকপোয়া ছিল ইরানের পরমাণু প্রকল্পের শর্তসাপেক্ষ অনুমতি– শক্তিধরদের পক্ষ থেকে। বারাক ওবামা বলেছিলেন– এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনবে ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে। ওবামা তাঁর ভাষণে বলেছিলেন– আমি জানি ইরান থেকে আওয়াজ উঠেছে ‘ডেথ টু আমেরিকা’। কিন্তু এটা কট্টরপন্থীদের কথা– ইরানের জনগণের নয়। জেকপোয়ার সমর্থন জানায় রাষ্ট্রসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও! যদিও ইসরাইলের সঙ্গে সউদি আরব ওবামার এই উদ্যোগে সমর্থন জানায়নি।

ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার পর ইরানের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবন্ধকতা লাগায় তাতে বিশ্বের বাজারে ইরানের তেল বিক্রি বন্ধপ্রায় হয়ে পড়ে। আমেরিকার ভয়ে বেসরকারি কোম্পানিও ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখে। বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কে ইরানের অর্থ ফ্রিজ করে দেওয়া হয়– যার পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন  ডলার। বহিঃবিশ্বের বহু চুক্তিও বাতিল করে দেওয়া হয়। ইরানের অর্থনীতিতে ধ্বস নামানোর সবরকম চেষ্টা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরান সামারিক শক্তিতে যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে এবং একদিকে চিন ও অপরদিকে রাশিয়াকে মিত্র হিসেবে পাশে পেয়েছে— এটাই এখন ভয়ের কারণ ইসরাইলের জন্য।

ট্রাম্পের আমলে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে বাহরাইন–  মরোক্কো– আমীরাত-সহ কয়েকটি মুসলিম দেশকে বন্ধু বানাতে চায় ইসরাইল। উদ্দেশ্য– বৃহত্তর ইসরাইল গঠন ও আরবের তেলসম্পদ হাসিল করা। ইরানের জুজু দেখিয়ে ইসরাইল ও আমেরিকা মুসলিম দেশগুলিকে নিজের শিবিরে আনায় ভরপুর কোশেশ করেছে। কিন্তু সিরিয়া ইরাক– ইয়েমেন– লেবানন নিয়ে কামিয়াব হতে পারেনি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জারি রয়েছে এখনও। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানো এবং ফিলিস্তিনের হামাসের মিসাইলে ইসরাইলের বসতি লণ্ডভণ্ডের ঘটনায় কিছুটা হলেও শঙ্কিত ইসরাইল। গত সপ্তাহে নাফতালি বেনেট আবু ধাবি এসে সংবাদ মাধ্যমের সামনে জানালেন–  আমরা সবাই হযরত ইব্রাহিমের গ্রান্ড চাইল্ড– আমরা আপনাদের প্রতিবেশি– আরবরা আমাদের জ্ঞাতিভাই। অবশ্য সেই সাংবাদিক বৈঠকে এমন কেউ ছিলেন না— যিনি জিজ্ঞেস করবেন ফিলিস্তিনের আরবরা তাহলে আপনার কে? অবশ্য আমীরাত এবং সউদি আরবেও ইসরাইল বিরোধিতাকে এখন অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে– বরং ইরানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে এবং শিয়া আগ্রাসনের খবর ছাপা হচ্ছে শিয়া-সুন্নি বিরোধকে সামনে আনার জন্য।

ভিয়েনা বৈঠক ব্যর্থ হলে তাই আশঙ্কা জাগছে— সত্যই কি মহাযুদ্ধ বেঁধে যাবে মধ্যপ্রাচ্যে– নাকি ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ার আরও একটি দুঃসাহস দেখাবে বাইডেন প্রশাসন?

যুদ্ধে কি জড়িয়ে পড়বে ইরান ও ইসরাইল?

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

যুদ্ধে কি জড়িয়ে পড়বে ইরান ও ইসরাইল?

আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, শনিবার

ইরানের দাবি– গবেষণার জন্য শান্তির লক্ষ্যে তাদের পরমাণু প্রকল্প। কিন্তু ইসরাইল মনে করছে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে ইরান। ইসরাইল-আমেরিকার অধিকার থাকলেও ইরানকে কোনও মতেই পরণু অস্ত্র তৈরির অধিকার দেওয়া যাবে না। জটিলতা কাটাতে আলোচনায় বসেছে পাঁচ শক্তিধর দেশ। এই নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন মুহাম্মদ আলাউদ্দিন। 

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ২৭ ডিসেম্বর অষ্টমবারের জন্য বৈঠকে বসছে ইরান ও বিশ্বের পাঁচটি শক্তিশালী দেশ। বৈঠকে থাকছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিও। ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ব্রিটেন– চিন– রাশিয়া– জার্মানী– ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

২০১৫ সালের এপ্রিলে বারাক ওবামার শাসনকালে ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে একটি সংযুক্ত কার্যপ্রণালীতে স্বাক্ষর করে আমেরিকা-সহ ছয়টি দেশ। পরে ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন এবং ইরানের উপর বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়।

ইরানকে ভাতে মারার চেষ্টা করা হলেও ইরান সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়ে ইসরাইল-আমেরিকাকে চোখ রাঙানোর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। সেই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি ইরানকে নিয়ে পুনরায় সংশোধিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই বছর নভেম্বরের শেষ ও ডিসেম্বরের প্রথম থেকে সাতবার বৈঠক হয় ভিয়েনায়। আমেরিকার চাপানো প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়া না হলে ইরান নতুন চুক্তিতে রাজি নয়– আর বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলিও চাইছে না মধ্যপ্রাচ্যে এখনই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাক। তাই ২৭ ডিসেম্বর অষ্টম ভিয়েনা বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব।

যুযুধান দুই পক্ষই রীতিমতো যুদ্ধের মহড়া শুরু করে দিয়েছে বৈঠকে বসার আগেই। একে অপরকে চাপে ফেলার জন্যই হোক– কিংবা সত্যকার যুদ্ধ বাধানোর মাস্টার প্ল্যান বানিয়ে রাখা হোক— ভিয়েনার বাইরেও জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। লড়াইয়ের পূর্বাভাস মনে হতে পারে যেসব বিষয়গুলি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

১) আমেরিকার নিরাপত্তা উপদেষ্টা গিয়েছেন তেলআবিবে– ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে। আলোচ্য বিষয় ইরানের হুমকি ও ভিয়েনা বৈঠক।

২) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এই সপ্তাহে এলেন আরব আমীরশাহী। নাকতালি বেনেট ও যুবরাজ শাইখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বৈঠক করেন ইরান নিয়েও। আমীরশাহী প্রতিনিধি পাঠিয়েছে তেহরানেও।

৩) ইরাকের প্রতিনিধি সউদি আরব ও ইরানকে নিয়ে তৃতীয় দফার বৈঠকের আয়োজন করেছেন বাগদাদে।

৪) আমেরিকা ঘোষণা দিয়েছে আর সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। ইরান ইচ্ছা করে বিলম্ব করছে। এবার ইসপার-উসপার সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

৫) ইরান প্রকাশ্যে জানাল– তাদের পরমাণু প্রকল্পের উপর আঘাত এলে তেলআবিব ও হাইফাকে নির্মূল করে দেওয়া হবে মানচিত্র থেকে।

৬) আমেরিকার হার্ড-লাইনার নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন– বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে এনে দেশের মর্যাদা হানি করেছে। তাই এবার ইরানের কাছে মাথা নত করা এবং ইরানের শর্ত মেনে নেওয়া যাবে না।

৭) ‘তেহরান টাইমস’ তাদের দৈনিক কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ম্যাপ এঁকে জানিয়ে দিয়েছে ইসরাইলের কোন কোন শহর ও সামরিক ঘাঁটি এবং আরব দেশে কোন কোন মার্কিন সেনা ঘাঁটিগুলি তাদের ব্যালাস্টিক মিসাইলের পাল্লার মধ্যে রয়েছে।

৮) ইরানকে আঘাত করার জন্য অস্ত্রবাবদ ১.৫ বিলিয়ন ডলার সম্প্রতি বরাদ্দ করেছে ইসরাইল।

৯) আমেরিকা ও ইসরাইলের সেনাবাহিনী শক্তি পরীক্ষার জন্য মকড্রিল করেছে কয়েকদিন আগে।

আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এখন জোর চর্চা চলছে অষ্টমবারের ভিয়েনা বৈঠক নিষ্ফলা হলে ইরানের সঙ্গে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলি কি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? এবার কি আরও কয়েকটি মুসলিম দেশ বরবাদির তালিকায় এসে যাবে? আন্তর্জাতিক সমর বিশেষজ্ঞদের অভিমত– ২০১৮ সালে ট্রাম্প জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন বা জেকপোয়া থেকে সরে আসার পর ইরান ভিতরে ভিতরে পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে অনেক এগিয়ে গেছে। সমরাস্ত্রে শক্তিধর দেশের তালিকায় ২০২১ সালে ইরান ১৪ নম্বরে– সেখানে ইসরাইল রয়েছে ২০-তে। ইরানের মেজর জেনারেল গুলাম আলি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন– তাদের ‘নেজাত’ মিসাইল মুহূর্তের মধ্যেই ইসরাইলকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। পরমাণু অস্ত্র লাগবে না– মিসাইলেই শেষ হয়ে যাবে ইসরাইল। সেনা প্রধান মুহাম্মদ বাঘারি হুমকি দিয়েছেন— ইরানের উপর সামান্যতম আঘাত এলেও পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য তিনটি বাহিনী তৈরি রয়েছে। একাধিক টার্গেটে হামলা করার জন্য তৈরি তারা।

অপরদিকে– ইসরাইল মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের সেনাবাহিনী কীভাবে সাদ্দাম হুসেনের জামানায় ইরাকের পরমাণু প্রকল্প ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাগোষ্ঠী ‘হামাস’ কিছুটা সফল হলেও ইসরাইল সম্পূর্ণ আয়রন ডোমের ভিতরে এখন নিরাপদ অবস্থায় চলে এসেছে। পাল্টা হুমকি দিয়েছে ইসরাইল— আমেরিকার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় নামার দুঃসাহস যেন না দেখায় ইরান।

জেকপোয়ায় কী কী শর্ত ছিল? ইরান পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ করেছে এই খবর চাউর হতেই সবচেয়ে বেশি ভীত হয় ইসরাইল। আয়াতুল্লাহদের ইরান ইসরাইলের কব্জা থেকে ফিলিস্তিন– জেরুসালেম ও মসজিদুল আকসা মুক্ত করার ডাক দেয় শুরু থেকেই। আমেরিকা ও ইসরাইল ইরানের কাছে দুশমন নাম্বার ওয়ান। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রধান এজেন্ডা ছিল আল আকসা উদ্ধার। তাই ইরানকে আন্তর্জাতিক চুক্তির শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলার জন্যই এই চুক্তি। যাতে ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাতে না পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ–  নজরদারি– ইন্সপেকশন রিপোর্ট গ্রহণ পাহারাদারি সব ধরনের খবরদারি করা হয় এই চুক্তিতে। তা সত্ত্বেও ইরান শান্তির উদ্দেশ্যে পরমাণু প্রকল্প জারি রাখে নজরদারির মধ্যেই।

অপরদিকে– ইসরাইলের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তোলেনি। ইসরাইল এখনও স্বীকার করেনি যে– তারা পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে কিংবা অস্বীকারও করেনি। রাষ্ট্রসংঘে প্রস্তাব আনা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যকে পরমাণু মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হোক। কিন্তু সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে ইসরাইল। আর ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে সন্ত্রাস বৃদ্ধির অজুহাত তোলা হয়। জেকপোয়া ছিল ইরানের পরমাণু প্রকল্পের শর্তসাপেক্ষ অনুমতি– শক্তিধরদের পক্ষ থেকে। বারাক ওবামা বলেছিলেন– এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনবে ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে। ওবামা তাঁর ভাষণে বলেছিলেন– আমি জানি ইরান থেকে আওয়াজ উঠেছে ‘ডেথ টু আমেরিকা’। কিন্তু এটা কট্টরপন্থীদের কথা– ইরানের জনগণের নয়। জেকপোয়ার সমর্থন জানায় রাষ্ট্রসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও! যদিও ইসরাইলের সঙ্গে সউদি আরব ওবামার এই উদ্যোগে সমর্থন জানায়নি।

ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার পর ইরানের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবন্ধকতা লাগায় তাতে বিশ্বের বাজারে ইরানের তেল বিক্রি বন্ধপ্রায় হয়ে পড়ে। আমেরিকার ভয়ে বেসরকারি কোম্পানিও ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখে। বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কে ইরানের অর্থ ফ্রিজ করে দেওয়া হয়– যার পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন  ডলার। বহিঃবিশ্বের বহু চুক্তিও বাতিল করে দেওয়া হয়। ইরানের অর্থনীতিতে ধ্বস নামানোর সবরকম চেষ্টা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরান সামারিক শক্তিতে যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে এবং একদিকে চিন ও অপরদিকে রাশিয়াকে মিত্র হিসেবে পাশে পেয়েছে— এটাই এখন ভয়ের কারণ ইসরাইলের জন্য।

ট্রাম্পের আমলে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে বাহরাইন–  মরোক্কো– আমীরাত-সহ কয়েকটি মুসলিম দেশকে বন্ধু বানাতে চায় ইসরাইল। উদ্দেশ্য– বৃহত্তর ইসরাইল গঠন ও আরবের তেলসম্পদ হাসিল করা। ইরানের জুজু দেখিয়ে ইসরাইল ও আমেরিকা মুসলিম দেশগুলিকে নিজের শিবিরে আনায় ভরপুর কোশেশ করেছে। কিন্তু সিরিয়া ইরাক– ইয়েমেন– লেবানন নিয়ে কামিয়াব হতে পারেনি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জারি রয়েছে এখনও। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানো এবং ফিলিস্তিনের হামাসের মিসাইলে ইসরাইলের বসতি লণ্ডভণ্ডের ঘটনায় কিছুটা হলেও শঙ্কিত ইসরাইল। গত সপ্তাহে নাফতালি বেনেট আবু ধাবি এসে সংবাদ মাধ্যমের সামনে জানালেন–  আমরা সবাই হযরত ইব্রাহিমের গ্রান্ড চাইল্ড– আমরা আপনাদের প্রতিবেশি– আরবরা আমাদের জ্ঞাতিভাই। অবশ্য সেই সাংবাদিক বৈঠকে এমন কেউ ছিলেন না— যিনি জিজ্ঞেস করবেন ফিলিস্তিনের আরবরা তাহলে আপনার কে? অবশ্য আমীরাত এবং সউদি আরবেও ইসরাইল বিরোধিতাকে এখন অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে– বরং ইরানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে এবং শিয়া আগ্রাসনের খবর ছাপা হচ্ছে শিয়া-সুন্নি বিরোধকে সামনে আনার জন্য।

ভিয়েনা বৈঠক ব্যর্থ হলে তাই আশঙ্কা জাগছে— সত্যই কি মহাযুদ্ধ বেঁধে যাবে মধ্যপ্রাচ্যে– নাকি ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ার আরও একটি দুঃসাহস দেখাবে বাইডেন প্রশাসন?

যুদ্ধে কি জড়িয়ে পড়বে ইরান ও ইসরাইল?