প্রসেনজিৎ দত্ত: অজানা সিনেমাপাড়ায় পা রাখলেন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার। এই সিনেমাপাড়া তাঁর বরাবরেই প্রিয়। ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ নামে একটা আস্ত বইও লিখেছিলেন। দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনের বহু অভিজ্ঞতা মোড়া এই বই। বহু অমূল্য স্মৃতি দিয়ে গড়া এই বইয়ের লেখক তরুণ মজুমদার ৯১ বছর বয়সে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
বহু তরুণকেই সুপারস্টার বানিয়েছেন এই প্রবাদপ্রতিম পরিচালক। তাপস পাল, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, নয়না দাস, অয়ন মুখোপাধ্যায় তাঁরই হাতে গড়া। পরিচালনার জগতে গুরুবাদী পরম্পরার আদর্শ মুখ বলতে যা বোঝায়, তার আদর্শ উদাহরণ তিনি। শিল্পী গড়ার কারিগর ছিলেন। একথা বলেছেন খোদ অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। টলিউড জুড়ে তাই ‘গুরু’ হারানোর কান্না। এমন একজন আদর্শ চলচ্চিত্রকারের মৃত্যুতে হবে না কোনও শোকমিছিল। জানিয়ে দিয়েছে পরিবার। তাঁর দেহ ও কর্নিয়া দান করা হবে। শেষশ্রদ্ধার পর এসএসকেএম থেকে দান করা হবে দেহ।
হ্যারিকেন তুলে ধরে বারবণিতার মুখ দেখা কিংবা কারোর ফোকলা মুখের সঙ্গে খণ্ড দৃশ্যে গরুর হাঁ-মুখ দেখিয়ে চিত্রকল্প গড়া এই পরিচালকের প্রয়াণে শোকের ছায়া। ‘সংসার সীমান্ত’-এর দৃশ্য এগুলো। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রথেলে ঢুকছেন ঘোমটা মাথায় দিয়ে। কারণ সেখানে ঢোকা তথাকথিত ভদ্র সমাজে শোভা পায় না। আর অন্য এক বয়স্ক লোকের হাতে হ্যারিকেন। তিনি হ্যারিকেন তুলেই বারবণিতা মুখ দেখে পছন্দ করবেন। একজনকে পছন্দ হতেই তিনি হেসে ফেলেন। সেই সময়ই জাম্পকাট। ঢুকে পড়ে গরুর মুখ। সে হাঁ করে। আসলে গরুর দাঁত দিয়েই ওই দৃশ্যে বয়স বোঝাতে চেয়েছেন পরিচালক। ক্যামেরার রোলের এমনই জাদুগর তিনি।
আরও একটা বিশেষ দিক হল, কেবল বাণিজ্যিক সিনেমা তিনি তৈরি করেননি। গ্রামবাংলার কথা তুলে ধরতে বরাবরই উদ্যোগী ছিলেন। সাদাসরল জীবনে কুৎসিত-কদর্য রাজনীতির চোখরাঙানিকে দেখাতে পিছপা হননি। এমন কিংবদন্তি মানুষটার মৃত্যুতে মনখারাপ আমবাঙালির। তাঁর নিথর দেহটা শোয়ানো। বুকে রাখা রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’। এই গ্রন্থের মাহাত্ম যে ‘গীতা’র মতোই। শেষ জয়ে বিজয়ী করার মন্ত্র লেখা সেখানে। “আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার / তোমার কাছে রাখেনি আর সাজের অহংকার।” তরুণ মজুমদারের জীবন এমনই।