পুবের কলম প্রতিবেদক: কলকাতার মহানাগরিক ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক ব্যঙ্গচিত্র।
এ কোন হীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ! আজকের সিপিএম-অনুসারীরা কি মুসলিমদের এই রকমভাবেই পালাতে দেখতে পছন্দ করেন? তাঁরা কি বিশ্বাস করেন যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে মুসলিমরা ফেজ টুপি পরেই পালাবেন? তাদের অসাম্প্রদায়িকতা আর প্রান্তিক মানুষের পাশে থাকার বুলি কোথায় গেল! লিখছেন সৈয়দ তানভীর নাসরীন
ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরাইলের আক্রমণ, না ডিওয়াইএফআই-এর নেত্রী কমরেড মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র, শনিবারের সকালে কোনটা এই বঙ্গের মুসলিমদের বেশি ব্যথিত করবে— সেটা ভাবছিলাম।
একদিকে আমেরিকার মদদে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের ক্রমাগত বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে সেই হামলার সময় নির্বাক হয়ে বসে থাকা ভারতবর্ষের তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষজন। কিন্তু এঁরা আসলে কতটা প্রগতিশীল— সেটা বুঝতে পারলাম ২৫ অক্টোবর, শুক্রবার রাতে সিপিএমের মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের একটি পোস্ট দেখে।
যে পোস্টে তিনি কলকাতার মেয়র, স্বাধীন ভারতবর্ষের একমাত্র মুসলিম মেয়র, যাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই শহরে মেয়রের দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই ফিরহাদ হাকিমের একটি ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করা দেখে।
ওই ব্যঙ্গচিত্রে ফিরহাদের হাতে মদের বোতল, পিছনে মসজিদের আবছা নিশানা আর দুপাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন দিশাহারা মুসলিম জনগণ। মুসলিম কী করে বুঝলাম?
কারণ প্রত্যেকের মাথাতেই ফেজ টুপি, লম্বা দাড়ি। অর্থাৎ আমাদের দেশের ‘স্টিরিওটাইপ’-এ— যা দিয়ে মুসলিমদের আইডেন্টিফাই করা হয়। বুঝলাম কমরেডরা এখনও এই ‘স্টিরিওটাইপ’— এই মুসলমানদের দেখতে অভ্যস্ত। তাঁরা জানেন না আসলে কত মুসলমান আজ আইআইটিতে চাকরি করেন, বা তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যেসব মুসলমানরা কাজ করেন, তাঁরাও কি মাথায় ওই ফেজ টুপি পরেই দৌড়োন?
মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, যিনি নিজের উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রান্তিক প্রমাণ করবার বা সর্বহারা মানুষের প্রতিনিধি প্রমাণ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যান, তিনি আসলে সত্যি সত্যি কতটা দলিত কিংবা মুসলমানদের বোঝেন— সেটা বোধহয় এই ব্যঙ্গচিত্রটিই প্রমাণ করে দিয়েছে।
তৃণমূলের এক অভিনেত্রী সাংসদের কিছু ভুল মন্তব্য বা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের হয়তো মুখ ফসকে বলা কিছু ভুল শব্দকে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা সাম্প্রদায়িকতার সমস্ত নজিরকে ছাড়িয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। হয়তো আরএসএস বা হিন্দুত্বের সবচেয়ে উগ্র সংগঠনগুলিও এই পোস্টটি করার আগে অনেকবার ভাবত। কারণ পিছনে মসজিদ এবং দু’পাশ দিয়ে উদ্ভ্রান্ত মুসলিমদের দৌড়ে যাওয়া, এর চাইতে নিকৃষ্টভাবে মুসলিমদের দেখানোর কোনও উপায় নেই।
বুঝতে পারছি না যে, লেনিন, স্টালিন এবং মাও সে তুং-এর দর্শন পড়ার পরে আজকের সিপিএমরা কি মুসলিমদের এইরকম দিকভ্রান্তভাবেই পালাতে দেখতে পছন্দ করেন? তাঁরা কি বিশ্বাস করেন যে-কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে মুসলিমরা ফেজ টুপি পরেই পালাবেন?
এখনও মুসলিমদের এই ‘স্টিরিওটাইপ’-এই দেখতে পছন্দ করেন কমরেড মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা? যাঁকে আবার ‘ক্যাপ্টেন’ বলে সম্বোধন করে অনেক কমরেড গর্বিত হন এবং তাঁকে ভবিষ্যতের নেত্রী হিসেবে তুলে ধরতে চান?
কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে আমি চিনি না, আর তাঁর তো আমাকে চেনার প্রশ্নই ওঠে না। আমি বর্ধমানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। কোনওদিন কোনও অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়নি। কিন্তু এটুকু জানি, পরাধীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতাকে তার প্রথম মুসলিম মেয়র উপহার দিয়েছিলেন।
আর স্বাধীন ভারতবর্ষে যে সাহস কেউ দেখাতে পারেনি, সেই কলকাতা শহরকে একমাত্র মুসলিম মেয়র দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর নাম ফিরহাদ হাকিম।
ফিরহাদ হাকিম কিছু ভুল বলতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে ব্যঙ্গচিত্রে তাঁকে মদের বোতল হাতে মসজিদের সামনে বসিয়ে দিতে হবে?
এতটা সাম্প্রদায়িক বা এতটা ঘৃণ্য প্রচারে চলে গেছেন ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা? তথাকথিত যুব আন্দোলনের নেত্রীরা?
পুজোর সময় আমি এমন একটি দেশে ছিলাম, যে দেশটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য ছিল। সেই দেশটির নাম উজবেকিস্তান, যে উজবেকিস্তানে জনসংখ্যার নিরিখে ৯৫ শতাংশই মুসলিম। সেই উজবেকিস্তানে মুসলিমদের সবচেয়ে পুরোনো সংস্কৃতির কেন্দ্র বুখারায় আমি এখনও লেনিনের ছবি দেওয়া বই বিক্রি হতে দেখলাম।
কিন্তু লেনিনও হয়তো চমকে যেতেন যে তাঁর ভক্ত বলে যাঁরা নিজেদের পরিচয় দেন, তাঁরা মুসলিমদের এইরকম অপমান করতে পারেন। বুখারা থেকে ফিরে আসার পর এত বড় সাংস্কৃতিক, মানসিক আঘাত বোধহয় আমি প্রত্যাশা করতে পারিনি, তাও আবার সিপিএমের ঘোষিত ‘ক্যাপ্টেন’-এর কাছ থেকে।
বামপন্থার চর্চা যেহেতু অল্পবিস্তর আমারও আছে, আমি বুঝতে পারি না যে, আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার কমরেডরা কিংবা তথাকথিত শহরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে অভ্যস্ত সিপিএমের নেতানেত্রীরা এত উদ্ধত, এত সংকীর্ণমনা কেন হন?
নিজেদের অন্যদের চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং শ্রেষ্ঠতর জীব প্রমাণ করতে কেন তাঁরা বারবার অন্যদের অপমানের পথ বেছে নেন? তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বস্তির মেয়ে থেকে শুরু করে তাঁর বিভিন্ন উচ্চারণ নিয়ে হরেক ব্যঙ্গ করেন। ব্যঙ্গ করেন তৃণমূলের অনেক নেতানেত্রীদেরও।
তাঁরা ভুলে যান যে, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের কী পুরোনো ইতিহাস রয়েছে! সেই ইতিহাসকে আমি মনে করাতে চাই না। কিন্তু আজকের সিপিএমের যুব নেতানেত্রীরা অন্যদের ব্যঙ্গ করতে গিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে নিজেদের হাত সেঁকছেন, সেটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া উচিত।
ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে এই ব্যঙ্গ শুধু ফিরহাদ হাকিমের উপর আক্রমণের চেষ্টা নয়, আসলে সমস্ত মুসলমানদের অপমান করা, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মুসলমানকে ওই ফেজ টুপি পরে দিগভ্রান্ত হয়ে দৌড়োচ্ছে বলে ‘স্টিরিওটাইপ’-এ দেগে দেওয়া।
কমরেড মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে বুঝতে হবে যে তাঁদের নেতৃত্বের বাইরেই স্বাধীনভাবে একটি মুসলিম নেতৃত্ব ভারতবর্ষে তৈরি হচ্ছে, যারা এই ফেজ টুপি পরে দৌড়োয় না। তারা শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে আসছে। ফলে এই ফেজ টুপি আর মদের বোতল দিয়ে ‘স্টিরিওটাইপ’ করলে মুসলমানরা সিপিএমকে আরও প্রত্যাখ্যান করবে।
আমি ইতিহাসের ছাত্রী। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসে পড়েছি কমরেড মুজফফর আহমেদ আর নজরুল ইসলাম একঘরে থাকতেন। নজরুলের জীবনধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন কমরেড মুজফফর আহমেদ।
আমি জানি না কমরেড মুজফফর আহমেদ আজ বেঁচে থাকলে এই পোস্ট দেখে কী বলতেন! রেজ্জাক মোল্লা, যিনি একসময় সিপিএমের কৃষক নেতা ছিলেন, তিনি দল ছাড়ার আগে যখন ‘নয়া জমানা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, তখন গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে বলতেন সিপিএম আসলে একটা মুখোপাধ্যায়-ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী ব্রাহ্মণকুলের দল। রেজ্জাকদার এই মন্তব্যকে আমরা অতিশয়োক্তি বলে ধরতাম।
কিন্তু শনিবার সকালে যেদিন পারস্যের সংস্কৃতি কেন্দ্র তেহরানে ইসরাইলের বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ছে, সেদিকে নজর না দিয়ে তার চেয়ে জোরে আছড়ে পড়ল এই সাম্প্রদায়িক প্রচার বা সাম্প্রদায়িক বোমা। বুঝলাম আবদুর রেজ্জাক মোল্লা ৪০ বছর সিপিএমের পতাকা বহন করার পর বহু যন্ত্রণা নিয়ে যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা ভুল নয়।
মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা আসলে সিপিএমের ব্রাহ্মণকুলের সেই সাম্প্রদায়িক প্রচারকেই ক্রমাগত উগড়ে যেতে থাকেন এবং বোঝেন না কেন সিপিএমের থেকে, লাল পতাকার থেকে মুসলমানরা দূরে সরে গিয়েছেন। এই না বুঝতে পারাটাই তাঁদের শূন্য থেকে শূন্যতর করেছে এবং মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের বিপ্রতীপ সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে।
মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা বা তাঁর কমরেডকুল গাজায় সমস্ত হাসপাতাল ভেঙে দিলেও প্রতিবাদ করেন না, এটা বুঝেছিলাম। প্রতিবাদ করেন না ফিলিস্তিন বা লেবাননে হাজারো মুসলিমের মৃত্যুর পরেও, কারণ আজকের ভারতবর্ষে সিপিএম বা মীনাক্ষীর সংগঠন ডিওয়াইএফআই আর প্রগতিশীলতার বহন করে না।
ফরেন্সিক রিপোর্ট প্রমাণ করেছে ক্যানিং-এর ছেলে সাবির মল্লিকের ঘরে গো-মাংস ছিল না। তাকে হরিয়ানায় পিটিয়ে মারার ঘটনায় টুঁ শব্দটি করেননি বামপন্থীরা। শুধু সাবির মল্লিক কেন, দ্রোহের কার্নিভালে একটি শধও উচ্চারিত হয়নি— সেই হতভাগ্য বাঙালি শ্রমিকদের জন্য, যাদের একজনকে পিটিয়ে মারা হয় রাজস্থানে, আর একজনের ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল মহারাষ্ট্রে।
পুনশ্চ: এই পোস্টকে ঘিরে শোরগোল শুরু হওয়ার পরে, মীনাক্ষী দাবি করেন, ওই আইডি-টি তাঁর নয়। কিন্তু এতদিন যে প্রোফাইল থেকে লাগাতার সিপিএমের প্রচার করা হয়েছে, তার দায় তো মীনাক্ষীদের নিতেই হবে। প্রবল সমালোচনার মুখে মীনাক্ষী জানিয়েছেন, তিনি লালবাজারে সাইবার ক্রাইমের তাঁর ফেক প্রোফাইল করা হয়েছে বলে একটি অভিযোগও দায়ের করেছেন। বিনীতভাবে বলতে চাই যে, তাঁর আলোচিত প্রোফাইলটির ২৯ হাজার ফলোয়ারস রয়েছে। প্রশ্ন, তিনি আগে কেন তাঁর এই প্রোফাইলটি যে ফেক প্রোফাইল তা নিয়ে পুলিশে অভিযোগ করেননি?
আর আগেই বলেছি, এই প্রোফাইলটি থেকে মীনাক্ষী দেবীর দল সিপিএম-এর পক্ষে রীতিমতো প্রচার করে পোস্ট করা হচ্ছিল। আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সময়, (যে আন্দোলনকে সি পি এম তখনও ‘প্রগতিশীল ‘আখ্যা দিয়েছিল), সেই আন্দোলনের একজন নেতা একটি কার্টুনে বিষধর সাপের মাথায় ফেজটুপি পরিয়ে দিয়েছিলেন। অনেকের মনে থাকবে সেই ছবি। মুসলমান মানেই সাপের মতো বিষধর, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বার্তা ছড়িয়ে ‘আমার অফিসিয়াল আই ডি নয়’, বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন সেই ব্যক্তি। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট সেদিনও কোনও দুঃখ প্রকাশ করেনি।
1 Comment
Pingback: জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে জুনিয়র ডাক্তারদের নয়া সংগঠন,অনিকেতের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের হুঁশ