পুবের কলম, ওয়েব ডেস্কঃ রাজ্যে মোটি ‘শত্রু সম্পত্তি’ রয়েছে ৪,৩৭৬টি। এগুলির মধ্যে ৫০০টিরও বেশি সম্পত্তি বেআইনিভাবে জবরদখল করা হয়েছে। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রকের এক রিপোর্টে এমনই দাবি করা হয়েছে। এমনিতেই দেশভাগের যন্ত্রণার সঙ্গে শত্রু সম্পত্তির বিষয়টি জড়িত। সেইসময় ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়া মানুষদের (মূলত মুসলিম) সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করা হয়। একইভাবে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যারা সেইসময় পাকিস্তান (মূলত বাংলাদেশ) থেকে ভারতে চলে যায় তাদের সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে সেইসব সম্পত্তিকেই অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ সরকারের তরফে। ভারত-চিন যুদ্ধের সময়ও অনেক চিনা নাগরিক তাদের সম্পত্তি ছেড়ে চিনে ফিরে গিয়েছিলেন। তাদের ফেলে যাওয়া সেই সম্পত্তিগুলিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে ধরা হয়।
কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে জবরদখল হওয়া ‘শত্র সম্পত্তি’র মধ্যে ৪৯টি সম্পত্তি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক আধিকারিক জানান যে, সরকার সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে যে, রাজ্যে ৪,৩৭৬টি শত্রু সম্পত্তি রয়েছে। সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক অর্থাৎ ৪,৩২০টি পাকিস্তানি নাগরিকরা রেখে গেছেন। আর ৫৬টি সম্পত্তি চিনা নাগরিকরা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় তাঁরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ৫৩৬টি শত্রু সম্পত্তিতে দখলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত ৪৯টি সম্পত্তি থেকে জবরদখলকারীদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। তবে কোনও শত্রু সম্পত্তি বিক্রি করা হয়নি। রাজ্যে এই ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রে গত তিন বছরে ৬৯ লক্ষ ৭২ হাজার টাকার ইজারা সংগ্রহ করা হয়েছে।
শত্রু সম্পত্তি আইনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫৩৬টি সম্পত্তির দখল নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ৪ হাজার ৩৭৬ জনের সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের নাগরিকদের সম্পত্তির সংখ্যা ৪৩২০টি। চিনের নাগরিকদের সম্পত্তির পরিমাণ ৫৬টি। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যের পাকিস্তান ও চিনা নাগরিকদের ৫৩৬টি শত্রু সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি আইনে’ দখল নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। গত তিন বছরে রাজ্যে পাকিস্তান ও চিনের নাগরিকদের একাধিক শত্রু সম্পত্তি বিক্রি না করে ভাড়া বাবদ রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। কলকাতার উপকণ্ঠে বিবাদিবাগ, ৭৮ এ ও বি শেক্সপিয়ার সরণি এবং দক্ষিণ ট্যাংরা রোড— এইসব এলাকায় সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। এইসব সম্পত্তি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দখল নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ™শ্চিমবঙ্গের মধ্যে মুর্শিদাবাদে সবচেয়ে বেশি শত্রু সম্পত্তি রয়েছে ১,৭২৮টি। ৫৩৬টি সম্পত্তি দখল হয়ে রয়েছে। এগুলির পুনরুদ্ধারে প্রাথমিকভাবে ৪৯টি ক্ষেত্রে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব সম্পত্তি ই-নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। কলকাতায় ৯০টি শত্রু সম্পত্তি চিহ্নিত করা হয়েছে। শত্রু সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে ১০০টি পাকিস্তান নাগরিকের সম্পত্তি, বীরভূমে ৪২৭টি পাকিস্তান নাগরিকের সম্পত্তি সম্পত্তি রয়েছে। পশ্চিম বর্ধমানে ১টি, পূর্ব-বর্ধমানে ৬২৫টি, কোচবিহারে ৭১১টি, হাওড়াতে ১টি, হুগলিতে ৩৮টি, জলপাইগুড়িতে ৩৯১টি, কলকাতায় ৭১টি, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ২৩টি, মালদায় ৫৩টি, নদিয়াতে ৮৮টি, পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৮টি, পূর্ব-মেদিনীপুরে ৬টি, দক্ষিণ দিনাজপুরে ২১টি ও উত্তর দিনাজপুরে ১৮টি পাকিস্তানি নাগরিকদের সম্পত্তি চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ, কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে সর্বাধিক ১,৭২৮টি শত্রু সম্পত্তি মুর্শিদাবাদে অবস্থিত। তারপরে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কোচবিহারে ৭১১টি, পূর্ব বর্ধমানে ৬২৫টি, বীরভূমে ৪২৭টি এবং আলিপুরদুয়ারে ১০০টি শত্রু সম্পত্তি রয়েছে। এগুলো সবই পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, চিনা নাগরিকরা যে শত্রু সম্পত্তি রেখে গেছেন তার মধ্যে রয়েছে কলকাতায় ১৯টি, কালিম্পংয়ে ১৭টি, দার্জিলিংয়ে ১৩টি, জলপাইগুড়িতে ৫টি এবং আলিপুরদুয়ারে ২টি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের পূর্বতন সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক মাস আগে সে-দেশের সংসদে জানানো হয়েছিল, ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পাস করা হলেও তা কার্যকর হয় ২০১২ সালে। এই আইনের উদ্দেশ্যে ছিল— জনগণের দাবি করা সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া। এর অংশ হিসেবে সরকার দু’টি গেজেট প্রকাশ করে। একটি ‘ক’ আরেকটি ‘খ’। ‘খ’ তালিকায় থাকার অর্থ হল— সরকার সেসব সম্পত্তি দাবিদারকে দিয়ে দেবে। আর যেসব সম্পত্তি সরকারের দখলে থাকবে সেগুলো ‘ক’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে কেউ যদি মনে করে যে ওই তালিকাভুক্ত সম্পত্তির মধ্যে তার সম্পত্তি আছে তাহলে সে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সেই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারবে। প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে ‘খ’ তপশিলভুক্ত সম্পত্তি বাদ দিয়ে ২০১৩ সালে সংসদে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন পাস করা হয়। সরকারি হিসাবে দেশে অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ৬ লাখ ৬০ হাজার একর। সারাদেশে অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা দাবি করা চার লাখের বেশি ভুক্তভোগীর মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১ অনুসারে— ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পর্যন্ত যেসব পাকিস্তানি নাগরিক পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের স্থাবর সম্পত্তি যা পাকিস্তান আমলে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ও বাংলাদেশ আমলে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নামে অভিহিত হয়েছিল, তা ফেরত পেতে পারেন। এই আইনের ২০০১ সালে প্রথমবার এবং ২০১২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধিত হয়। সংশোধিত আইনের ৯-ক ধারা অনুযায়ী, সরকারি গেজেটে মৌজাভিত্তিক জেলাওয়াড়ি তালিকা প্রকাশের পর কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেকে অর্পিত সম্পত্তির দাবিদার মনে করলে, তার দাবির সমর্থনে প্রয়োজনীয় প্রমাণ সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির সভাপতি অথবা ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে। তবে এই সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্তও রয়েছে। ১. সরকারি গেজেটে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে তা ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। না করলে অর্পিত সম্পত্তি সরকারি দখলে নিয়ে তা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। ২. অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে হলে দাবিদারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। ৩. বিনিময় মামলার আওতায় যারা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য তাদেরকে ভারতে প্রদত্ত সম্পত্তির বিবরণী জমা দিতে হবে। প্রসঙ্গত, ইসপাহানির মতো একাধিক নামি সংস্থা সেইসময় এ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশ চলে যায়। তাদের বড় বড় চটকল, প্রচুর জমি ছিল। সেগুলি শত্রু সম্পত্তি হয়ে গিয়েছে।