সাকিল আহমেদঃ মগরাহাট আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগে বিষমদ পান করে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিল ১৭২। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সেই ঘটনার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে একটি পরিচিত নাম, সংগ্রামপুর। কেমন আছে সংগ্রামপুর? মদের ঠেকগুলো কি আগের মতো রমরমা? কালিকাপোতা, বাহিরপুয়া হয়ে মগরাহাটের বিলন্দপুর গ্রামে এখনও কি চলে মদ্যপায়িদের দাপট? নাকি সেসব এখন অতীত? অনুসন্ধানে উঠে এল খণ্ডচিত্র। অবশ্য আসরে আজ নেই সেই খোঁড়া বাদশা। গোচরণ থেকে যে চোলাই মদ কিনে এনে নিজের ঠেক থেকে বিক্রি করতে গিয়ে পড়েছিল বিপদে। এই মদ কি নেশা খোরদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ ছিল নাকি ব্যবসার অন্তর্ঘাত? নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাল, তা রহস্যই থেকে গেল।
সংগ্রামপুর বিষমদ কাণ্ডের মূল নায়ক খোঁড়া বাদশা, সহ আয়ুব আলি, ইয়াসিন, দুখে লস্কর আদালতে সরকারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছেন। সংগ্রামপুর বিষমদ-কাণ্ডে আগেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। ২ আগস্ট ২০২১ সালে এই মামলায় রায় ঘোষণা করে আলিপুর আদালত। এদিনই আদালত নূর মুহাম্মদ ফকির ওরফে খোঁড়া বাদশাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে। ফলে আমৃত্যু জেলেই থাকতে হবে নূর মুহাম্মদ ফকিরকে।
২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মগরাহাট, উস্তি-সহ আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিষমদ পান করে মৃত্যু হয় ১৭২ জনের। যা সংগ্রামপুর বিষমদ-কাণ্ড হিসেবে পরিচিত। এই ঘটনায় মগরাহাট এবং উস্তি থানায় দু’টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। রাজ্য সরকার এই বিষমদ কাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব তুলে দেয় সিআইডির হাতে। উত্তেজিত জনতা মদের ঠেক থেকে শুরু করে আয়ুব আলি, খোঁড়া বাদশার বাড়িতে ভাঙচুর এবং লুঠপাট চালায়। তদন্তে জানা যায় যে, চোলাই মদ খেয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেই চোলাই মদ বানাত মগরাহাটের বিলিন্দপুর গ্রামের কুখ্যাত ডন নূর মুহাম্মদ ফকির ওরফে খোঁড়া বাদশা। এদিকে, মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল খোঁড়া বাদশাকে। বিচার চলাকালীন দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জেলবন্দি থাকতে হয় তাকে। অবশেষে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ৪টি ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয় আলিপুর আদালত।
পুরানো এই মামলার সাজা ঘোষণার দিন এজলাসে ওঠে মামলাটি। সাজা ঘোষণার আগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া খোঁড়া বাদশাকে কিছু বলার সুযোগ দেন বিচারক। এজলাসে দাঁড়িয়ে খোঁড়া বাদশা বিচারককে বলেছিলেন, ‘‘তিনি প্রতিবন্ধী, তার বাড়িতে ২২ বছরের মেয়ে এবং দুই ছেলে আছে। এছাড়াও ইতিমধ্যে ১০ বছর জেলে কাটিয়েছেন। তাই এবার বাড়িতে পরিবারের কাছে ফিরতে চান। তার শারীরিক এবং পারিবারিক দুর্দশার কথা মাথায় রেখে যেন সাজা দেওয়া হয়।’’ আদালতের কাছে এই আর্জি জানান খোঁড়া বাদশা নিজে। যদিও তাতে শেষরক্ষা হয়নি। এই আর্জি জানানোর আধ ঘণ্টার মধ্যে রায় ঘোষণা করেন বিচারক। মগরাহাট বিষমদ মামলায় আজীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত।
কে এই খোঁড়া বাদশা? তার ঝা-চকচকে বাড়িতে ঢুকলে মনে হবে একটা প্রাসাদসম বাড়ি। বাইরে বিরাট লোহার গেট। ঝি-চাকরে ভরা। রমরমিয়ে চলছে মগরাহাট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের পাশে রেস্টুরেন্টে-হোটেল ব্যবসা, গ্যাসের ব্যবসা। সেইসঙ্গে চোলাই মদের ব্যবসা। খোঁড়া বাদশা যেন এলাকায় তখন বেতাজ বাদশা। খোঁড়া বাদশার দাদা বলছিলেন, ‘‘আমরা নিজেরাই মদের ভাটিখানা ভেঙে দিই। ৭ বছর মদ তৈরি বন্ধ ছিল। তারপর গোচরণ থেকে চোলাই এনে বিক্রি করতে গিয়ে ফেঁসে যায়। ওয়াদা করেছিল সে আর এই লাইনে থাকবে না, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ফেঁসে যায় বিষমদ-কাণ্ডে। বাদশার ছেলে মেয়েরা এখন অনাহারে দিন কাটায়। বড় ছেলে সাবির ফকির বেকার। বাদশার ছেলে আমির ফকির আলি আজিজ মাছের আড়তে মুটের কাজ করে সংসার চালায়।’’
পরবর্তী পর্ব আগামী কাল।