একরামুল মোল্লাঃ আলিয়ার প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে একটি সভার অয়োজন করা হয়। ৫ই এপ্রিল ২০০৮ সালকে ধরে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। পবিত্র কুরআন তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে এদিন অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অবশ্য আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহন করছে সেই আলিয়া (কলকাতা) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮০ সালে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয় ৫ এপ্রিল ২০০৮ সালে।
ক্যালকাটা মাদ্রাসা থেকে কিভাবে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামক এক মহিরুহের জন্ম হল তার ইতিহাস তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন পরীক্ষা নিয়ামক ডক্টর তানবির আহমেদ। তিনি বলেন, ৭০০-৮০০ বছর মুসলিমরা এ দেশ শাসন করেছে। ১৭৫৭ সালে বাংলায় মুসলিমরা ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর শিক্ষা নিয়ে মুসলিমদের মাঝে একটা শূন্যতা তৈরী হয়। অথচ ইংরেজদের সঙ্গে আপোস করে হিন্দুরা চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। ইংরেজরাও অনুভব করে তাদের কিছু আরবি, ফারসি জানা মুসলিম কর্মচারি চাই। কলকাতা কিছু মুসলিম বিদ?জন গভর্নর জেনারেলের কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, তাদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হোক। ওয়ারেন হেস্টিংস সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ক্যালকাটা মাদ্রসা বা ক্যালকাটা মহামেডান কলেজ প্রতিষ্ঠায়। ক্রম বিবর্তনের ফলে তা এখন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে আগে মেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল না। তানবির আহমেদের উদ্যোগেই মেয়েরা এখানে পড়ার সুযোগ পান।
পুবের কলমের সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরানও তাঁর বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানটির অতীত ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইংরেজদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা পার্মানেন্ট সেটেলমেন্টের ফলে মুসলিমদের হাত থেকে জমি হিন্দু জমিদারদের হাতে চলে যায়। ফলে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু প্রথাগত সেই গন্ডির বাইরে বার হতে পেরেছিল কলকাতা মাদ্রাসা। তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃতদেহ নিয়ে একটা কুসংস্কার বদ্ধমূল ছিল। ফলে মানব কঙ্কাল ব্যবহার করে অ্যানাটোমি শিক্ষা বা লাশ কাটাছেঁড়া করা নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল। কোনও হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই তখন মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য জায়গা দিতে রাজি হয়নি। তবে কলকাতা মাদ্রাসা মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য জায়গা ও পরিকাঠামো দিতে রাজি হয়।
আ্যানাটোমির ক্লাস চালু হয় ১৯২৬ সালে। পরে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হলে এই বিভাগটি সেখানেও স্থানান্তরিত হয়। তবে বিশেষ করে মাদ্রাসার ছাত্ররা ক্যালকাটা মাদ্রাসা কলেজেও ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায়। ইমরান আরও বলেন, ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বই আলিয়ার প্রাক্তনী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (বাংলা ও পাকিস্তানের প্রিমিয়ার), মুহাম্মদ আলি চৌধুরি (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) ক্যালকাটা মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা করেছেন। বিজ্ঞানী কুদরত ই খুদা, নবাব আবদুল লতিফ, জাষ্টিস আমির আলির মত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বরা এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। শুধু বাংলা নয়, লাহোর, রেঙ্গুন তথা মধ্য এশিয়া থেকেও মেধাবী ছাত্ররা এখানে শিক্ষা লাভের জন্য আসতো। ইমরান আরও বলেন, দেশ ভাগের পর যখন আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় চলে যায় তখন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদই ফের কলকাতা মাদ্রাসাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। মাওলানা আজাদকে কলকাতা মাদ্রাসার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
ডেপুটি রেজিষ্টার ডক্টর সেখ আসফাক আলি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করে বলেন, ২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট সামনে আসে। দেখা যায় দেশের অন্যান্য রাজ্যের থেকে শিক্ষা, চাকুরিতে বাংলার মুসলিমরা অনেক পিছিয়ে। এরপর নড়েচড়ে বসে বাম সরকার। ২০০৭ সালে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল পাশ হয়। ৫ এপ্রিল তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তারপর নিউটাউন ও পার্ক সার্কাসের বেনিয়াপুকুরের আলিয়ার পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো গড়ে ওঠে।
আলিয়ার রেজিস্টার ডক্টর নুরুস সালাম আলিয়ার পডুয়াদের সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন, কে বলেছে মুসলিমরা পিছিয়ে পড়া? হয়তো তারা আর্থিকভাবে একটু পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পডুয়ারা গবেষণা করছে, আইআইটিতে চান্স পাচ্ছে। তারা সমাজ গঠনেও ভূমিকা রাখছে। এনআরসি আন্দোলনেও তারা যেমন নেতৃত্ব দিচ্ছে তেমনি রাতের বেলা দুঃস্থদের মাঝে তারা কম্বলও বিতরণ করছে।
এদিন অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক ডক্টর আয়াতুল্লা ফারুক ও অধ্যাপক গাজালা ইয়াসমিন। বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ডক্টর সাইফুল্লা, অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা চট্টপাধ্যায়সহ অন্যান্যরা। এদিন অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে ‘মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আউর তাকসিরি হাম আহাঙ্গি’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয় আহমদ হাসান ইমরান ও অন্যান্য বিশিষ্টদের হাত ধরে। পুস্তকটি সংকলন করেছেন উর্দু বিভাগের প্রধান ড. দ্রাকসান জাররিন।