বিপাশা চক্রবর্তী, কলকাতাঃ বর্তমান সময়ে যতই রাজনৈতিক অভিযোগ, কুৎসা, বিভাজনের রাজনীতি চলুক না কেন, মানুষ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী তার প্রতিফলন এবারেও দেখা গেল ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে। আলোর রোশনাইতে উপচে পড়েছে পার্ক স্ট্রিট। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের ঢল। সেই সঙ্গে চলেছে কলকাতা পুলিশের কড়া নজরদারি। প্রতি মুহূর্তে মাইকে পুলিশের তরফ থেকে করোনা বিধিনিষেধ মেনে চলার নির্দেশ চলেছে।
এবছর সবচেয়ে বড় আর্কষণ ৫৪ ফুটের ক্রিসমাস ট্রি, ৭ ফুটের সান্তা ক্লজ, ৭ ফুট লম্বা পরী। গত বৃহস্পতিবারই এই ক্রিসমাস ট্রি সহ সান্টা এবং পরীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। আগামী ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত পার্কস্ট্রিটে দর্শকদের স্বাগত জানাবে এই তিন চমক।
করোনার তাণ্ডব এখনও বজায় রয়েছে। সেই সঙ্গে আবার নতুন এসে জুটেছে করোনার নয়া ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। তবে থোড়াই কেয়ার! রাস্তা থেকে শুরু করে রেস্তরাঁ, সর্বত্রই মানুষের ভিড়। ভিড় উপচে পড়েছে রেস্তোরাঁ থেকে পানশালতে। একদিকে আলোর রোশনাই তার পাশে উৎসুক মুখের ভিড়ে এ যেন এক আলাদা কলকাতা। ছোট থেকে বড় সবাই বড়দিনের উৎসবের আনন্দে শামিল। আলোর রোশনাই সেজে উঠেছে বাহারি গেট। তার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফিতে মগ্ন ছোট থেকে বড় সকলেই।উৎসব প্রিয় মানুষ আনন্দ চেটে পুটে ভাগ করে নিতে ভিড় জমিয়েছে কলকাতার এই পার্ক স্ট্রিটে।
রাজ্যে করোনা, থেকে ওমিক্রনের দাপাদাপি চলেছে। তবে সেই আতঙ্ক উপেক্ষা করে ধরা পড়ল সেই গাফিলতির ছবি।
অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। মাস্ক পকেটে বা থুতনির কাছে ঝুলছ। কেউ বা সেলফি তোলার জন্য মাস্ক ঢুকিয়ে রেখেছে পকেটে। করোনা বিধিনিষেধকে তোয়াক্কা করে রঙিন টুপির বাহার, আলোকিত বেলুনে অন্য মুডে পার্ক স্ট্রিট। কোভিডবিধিকে বুড়ো থোড়াই কেয়ার করে, সেলফি তোলা থেকে শুরু করে হই-হুল্লোড়ে ব্যস্ত।
মুখে মাস্ক নেই এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই অনেকে ক্যামেরার সামনে দেখিয়ে দিলেন, ‘মাস্ক আছে পকেটে। অনেকক্ষণ পড়েছিলেন, তাই সবে মাত্র খুলে রেখেছেন।’ আবার কারুর মত এই সবে মাত্র রেস্তরাঁ থেকে রাতের খাওয়া সেরেছেন। তাই মাস্ক নেই।’ বলা বাহুল্য রাজ্য সরকারের সতর্কতা, কলকাতা পুলিশে সতর্কবাণী সব কিছুকে উপেক্ষা শুধুই উন্মাদনায় গোটা কলকাতা।
স্থানীয় মানুষও যেমন এসেছে, তেমনি কলকাতার বাইরেই পার্ক স্ট্রিটে মজা, আনন্দ শামিল হতে সুদূর হায়দরাবাদ থেকে এখানে এসেছেন দুই বন্ধু। আবার স্ত্রীকে নিয়ে দিল্লি থেকে এসেছেন এক ব্যক্তি। সকলের কথায় দেশের যে প্রান্তেই থাকি না, বড়দিন মানেই পার্ক স্ট্রিট। কারণ পার্ক স্ট্রিটের মতো উন্মাদনা, আন্তরিকতা আর কোথাও পাওয়া যায় না। সত্যি কলকাতা নগরী যে একটি প্রাণবন্ত শহর সে কথা উঠে এল তাদের এই শহরকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই। হাওড়া থেকে আসা এক গৃহবধূর কথায়, বড়দিন মানেই পার্কস্ট্রিট। এই সময় তার আকর্ষণ যেন আলাদা প্রতিটি শহরবাসীর কাছে।
শুক্রবার প্রায় তিনহাজার পুলিশ মোতায়েন রয়েছে পার্ক স্ট্রিট চত্বরে। ১০টি পুলিশ সহায়তা বুথ। নজরদারি চলছে ৩টি ওয়াচ টাওয়ার থেকে। পাশাপাশি রয়েছে ২টি কুইক রেসপন্স টিমও। রয়েছে সিসিটিভি। পার্কস্ট্রিট মোড়ে রয়েছে অস্থায়ী পুলিশ কন্ট্রোল রুমও।
উল্লেখ্য, খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস মতে, যিশু খ্রিষ্ট পৃথিবীতে মানুষের রূপ ধরে জন্মগ্রহণ করেন এই পৃথিবীর সকল পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে, মানুষে মানুষে বন্ধনকে আরও সুসংহত করতে। তাঁর এই তাৎপর্যপূর্ণ আগমনের তিথি স্মরণ করে তাঁর অনুসারীরা বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে এই শুভ বড়দিন উৎসব পালন করে থাকে। বড়দিন বা ক্রিসমাস একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা জানা যায় না। আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মা মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু।
সম্ভবত, এই হিসাব অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ ধরা হয়। অন্য মতে এটি একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব। অথবা উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসের অনুষঙ্গেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মজয়ন্তী পালনের প্রথাটির সূত্রপাত হয়। আলোকসজ্জা, শুভেচ্ছাকার্ড বিনিময়, উপহার দেওয়া-নেওয়া, চকলেট আদান-প্রদান, ঘুরতে যাওয়া, বড়দিনের কেক কাটা ও মিলন ভোজ-সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবই এই অনুষ্ঠানের অঙ্গ। দুর্গাপুজো, ইদ থেকে শুরু করে বড়দিন, প্রতিটি উৎসবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আজও সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে চলার মানসিকতা বর্তমান।