বাঙালি মুসলিমকে দাফন করে রাখতে হয় ভাষা দিবসের আবেগও

- আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২২, মঙ্গলবার
- / 15
সৈয়দ আলি মাসুদ
ফি বছর আসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কাঁটাতারের ওপারে এই দিনটি নিয়ে জনমনে যে আবেগ, তা এপার বাংলায় ফুটে ওঠে না সেভাবে। এপার বাংলায় দিনটিকে স্মরণ করা হয় মাত্র। তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা কম। দিনটিকে আলাদা মনে করিয়ে দেওয়ার তাগিদ বেশি। তাই কলকাতার বাইরে সাধারণ বাঙালির কাছে এবং বাঙালি মুসলিমের কাছে আলাদা করে এই দিনটির গুরুত্ব এতদিনেও তৈরী হয়নি।
কিন্তু এ প্রশ্ন কেউ তোলেন না যে, কেন বাংলা নিয়ে এপার বাংলার আবেগ তেমন জমল না। আসলে এ পারে বাঙালির সামগ্রিক পরিচয় তৈরি হল না আজও। যখন কারও নাম হয় অনিমেষ ভট্টাচার্য। তখন তাঁকে আলাদা করে কাউকে বোঝাতে হয়না যে তিনি বাঙালি। কিন্তু কারও নাম যদি হয় মুহাম্মদ জব্বার, তাঁকে বোঝাতে হয় যে তিনি বাঙালি মুসলমান। যার ফলে ধর্মকে পাশে রেখে ভাষা যে আপন পরিচয়ে পথ চলতে পারে তা এপার বাংলায় হয়নি। এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বাংলা মিডিয়া ও বাংলা সাহিত্য। সেখানে সুস্থ, রুচিসম্পন্ন বাঙালি মুসলিমের প্রতিনিধিত্ব উঠে আসেনি। মতান্তরে তুলে আনা হয়নি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর লেখাতেও বাঙালি বনাম মুসলিমদের ফুটবলের কথা ফুটে উঠেছিল।
কোনওকালে পত্র পত্রিকা, সাহিত্য কিংবা মিডিয়ায় উঠে আসেনি সুস্থ রুচিসম্পন্ন বাঙালি মুসলিমের কথা। বাঙালি মুসলিম সংস্কৃত মনস্ক নয়, এটাই প্রচার হয়েছে। একজন বাঙালি মুসলিম রোজা রাখেন এবং সাহিত্য চর্চা করেন, এমন মুসলিমদের আমাদের মূল স্রোতের মিডিয়া তুলে আনে না। মুখে কিছু না বললেও আসলে বাঙালি মুসলিমকে হিন্দু বাঙালির সংষ্কৃতিকে কপি করতে বলা হয়। তখনই মরে যায় আবেগটা ।
আবেগ যখন বাইরে আসে, তখন তা বহু সময় উজ্জাপনের রূপ নেয়। আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের উজ্জাপনের চিত্রজুড়ে থাকে আসলে বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। ঠিক যেন কোনও পুজোর প্রস্তুতি। আসলে বাঙালি হিন্দুর উজ্জাপন চিত্রে চেতনে কিংবা অচেতনে কোথাও একটা পুজোর ছবি সার্বিক হয়ে গিয়েছে। উজ্জাপনের সেই ঢংয়ে বহু সময় বাঙালি মুসলমান ভেসে যেতে চান না। উজ্জাপনের এমন রূপ তাদের পছন্দ নয়।আঁতেল হলেও সেই উজ্জাপন করতে হবে হিন্দু বাঙালির ঢংয়ে, এটা অনেকেরই অপছন্দ। তাই এপারের ভাষা দিবসের আবেগকে বুকে দাফন করে রাখেন বাঙালি মুসলিমদের অনেকেই।
বৃহত্তর ক্ষেত্রে হিন্দুরা চেতন কিংবা অচেতনে যা সংস্কৃতি বলে মনে করেন, তা আসলে তা ধর্মচর্চার বহিরং । পৌত্তলিকতার সঙ্গে মুসলিমরা আপস করতে পারেন না। অগ্নি, শঙ্খ, আল্পনা , দেবদেবীর মূর্তি কিংবা ছবিকে সামনে রেখে যখন উজ্জাপন হয় তখন বহু মুসলিম স্বর্তস্ফূর্ত থাকতে পারেন না। তারা আড়ষ্ট হয়ে পড়েন। এটা পরধর্ম অসহিংষ্ণুতা নয়। এটা আসলে নিজের আদর্শের প্রতি অনড় থাকা। নিজেকে কপটতা মুক্ত রাখা। আত্মপ্রবঞ্চনা না করা। এই ব্যাপারটা যতদিন সংখ্যাগরিষ্ঠরা বুঝবেন, ততদিন এই অবস্থার বদল হবে না। বহু আবেগ এইভাবেই দাফন হয়ে থাকবে মুসলিম মনে।