পুবের কলম প্রতিবেদক: মহিয়সী সমাজ সংস্কারক শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার স্মরণ দিবস উদযাপন করল পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশন। সোমবার দুপুরে কমিশনের কনফারেন্স হলের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান, প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. মমতাজ সংঘমিতা, মেম্বার সেক্রেটারি নুজহাত জায়নাব, সদস্য সতনাম সিং আলুয়ালিয়া, শেহনাজ কাদরি, আইনজীবী রফিকুল ইসলাম, বঙ্গীয় সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সভাপতি অধ্যাপক ওয়ায়েজুল হক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা ড. সাফুরা রাজেক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী সফিউর রহমান প্রমুখ।
কলকাতা কর্পোরেশনের তথ্য ও জনসংযোগ দফতর প্রযোজিত এবং মুজিবর রহমান পরিচালিত বেগম রোকেয়ার উপর নির্মিত তথ্যচিত্রের প্রদর্শনের মাধ্যমে এদিনের অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। ‘ছায়নট’ সংগীত সংস্থার কর্ণধার সোমঋতা মল্লিকের তত্ত্বাবধানে সমবেত সঙ্গীত ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ পরিবেশন করা হয়। আবৃত্তি পরিবেশন করেন তিস্তা দে, সুকন্যা রায়।
অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক ভাষণে সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান বলেন, ‘বিংশ শতাধীর প্রথম দশকে শুধু মুসলিম নারীরা নয়, হিন্দু মহিলারাও ঘোমটার আড়ালে থাকতেন। তাঁদের শিক্ষার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। ইসলাম নারীকে কোনও দিনই অবরোধবাসিনী করতে চায়নি। শালীন পোশাক পরা, হিজাব পরার কথা বললেও কখনই অবরোধের প্রথার কথা বলা হয়নি। ইসলাম নারীকে স্বতন্ত্র ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। যে ব্যবসায় তাঁর স্বামীর কোনও অধিকার নেই। বেগম রোকেয়া চেষ্টা করেছেন সমাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যেমন বিদ্যাসাগর চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু নারীদের মুক্তির জন্য। রামমোহন চেষ্টা করেছিলেন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য।’
বেগম রোকেয়ার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের তুলনা করে মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান ও পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক বলেন, ‘দু’জনেই নারী মুক্তি ও নারী শিক্ষার প্রসার চেয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনে বেশকিছু পুস্তক লিখেছেন। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য এখনও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার। সেই সাহিত্যকে আরও জনপ্রিয় করতে হবে।’ প্রসঙ্গক্রমে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইমরান বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার সোদপুর-পানিহাটির কবরস্থানটি আজ হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর সন্তান আমরা আছি। আমরা এই মহিয়সী নারীর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে তাঁর রুহের মাগফেরতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।’ তিনি বলেন, ‘বেগম রোকেয়া ’৪৭-এর পর পশ্চিমবঙ্গ থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। কেউ তাঁর কথা বলত না। ১৯৮৪ সালে কলম পত্রিকায় তাঁর জীবন নিয়ে আমি লিখেছিলাম। আর আনন্দবাজারে লিখেছিলেন গৌরী আয়ুব। তারপর থেকেই নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে নিয়ে ফের চর্চা শুরু হয়। তবে এখনও পর্যন্ত বেগম রোকেয়ার নামে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কিছু নেই।’ এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশে রোকেয়া চর্চার কথা তুলে ধরেন। বলেন, বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পশ্চিম বাংলায় বেগম রোকেয়াকে নিয়ে যারা চর্চা করেছেন, সেই বিশ্বকোষ পরিষদের প্রাণপুরুষ পার্থ সেনগুপ্তের অবদানের কথাও তিনি তুলে ধরেন।
এ দিনের সভায় অধ্যাপক ওয়ায়েজুল হক পশ্চিমবঙ্গে রোকেয়া চর্চায় আহমদ হাসান ইমরানের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি ডায়মন্ড হারবারের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়কে রোকেয়ার নামে নামকরণের প্রস্তাব দেন।
সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক কাজী সফিউর রহমান। তাঁর লেখা বই ‘বিদ্যাসাগর থেকে বেগম রোকেয়া শিশুশিক্ষার সারথি’- থেকে বিভিন্ন মজার ঘটনা ও পরস্পর বিরোধী কিছু বক্তব্যের তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বেগম রোকেয়ার বাংলা রচনা সম্পর্কে বলেন,‘একশো বছর আগের লেখা তাঁর রচিত বাংলা ভাষা আজকের দিনের আধুনিক ভাষার মতোই যুগোপযোগী। চমৎকার শধবন্ধ। তাঁর লেখা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। চিন্তা করতে সাহায্য করে।’ পাশাপাশি বেগম রোকেয়ার পারিবারিক, সাংসারিক জীবনের বিভিন্ন অনালোচিত দিক সামনে আনেন।
বক্তব্য রাখেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা ড. সাফুরা রাজেক। তিনি বলেন, ‘বেগম রোকেয়া তাঁর ভাবনা চিন্তা লিখে গিয়েছিলেন বলেই আজকের দিনে আমাদের মত নারীরা এগিয়ে আসতে পেরেছি।’ অধ্যাপিকা তাঁর আলোচনায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘ফারসি, উর্দু, আরবির পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরেজি শিখেছিলেন রোকেয়া। যার ফলে বিশাল তথ্যভাণ্ডার জানতে পেরেছিলেন। নারীর শিক্ষা দরকার নারীর মান সম্মানের জন্য। আর এটিই বেগম রোকেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল।’
এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট রোকেয়া গবেষক পার্থ সেনগুপ্তের সন্তান নিলাদ্রী সেনগুপ্ত মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরানের হাতে গৌতম ভট্টাচার্যের আঁকা বেগম রোকেয়ার ছবি এবং কিছু বই তুলে দেন।