এ হাসানঃ শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার কিছুটা ফেক হলেও বেশকিছু সত্যও কিন্তু রয়েছে। যেমন হঠাৎ করে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে। এটা সরকারি, বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি মিশরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মোল্লা মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দেখাশোনা, করমর্দন, আলিঙ্গন যেমন অনুষ্ঠিত হয়েছে তেমনি দুই প্রধানের মধ্যে বেশকিছু বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে।
শোনা যাচ্ছে, শীঘ্রই পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ইশহাক দার ঢাকা সফরে আসছেন। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মুহাম্মদ তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠক করবেন ইউনূস সাহেবের সঙ্গেও। দুই বিদেশমন্ত্রীর লক্ষ্য, পারস্পরিক দোস্তি আরও জোরদার করা। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অন্য যোগাযোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা কখনই তা এক নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে দেননি। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনারা বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকার পতন ঘটান, তা সর্বজনবিদিত। সেই সময়ের রক্তপাত, নৃশংসতা শেখ হাসিনা কখনোই ভুলতে পারেননি। তাই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য সবসময় জাগ্রত প্রহরির মতো সক্রিয় ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশও ব্রিটিশ উপনিবেশিকতাবাদীদের বিরুদ্ধে অহিংস ও সহিংস পদ্ধতিতে লড়াই করে আজাদি হাসিল করেন। কিন্তু স্বাধীনতা লড়াইয়ের তিক্ততা স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান ভুলে গিয়েছিল। নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং তা আরও উন্নত করার জন্য বরাবর চেষ্টা করে গেছেন। ব্রিটেনকে কোনও দেশই শত্রু তালিকায় ফেলেননি। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এই ধরনের কোনও তুলনা টানা সম্ভব নয়।
কিন্তু এখন ইউনূস সরকার এতদিন পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ভরপুর চেষ্টা শুরু করেছেন। অবশ্য প্রেমটা দুই পক্ষের।
শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি পর্যায়েও এই প্রেমদান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলে এই প্রেমকথা প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন এ কথা সকলেই জানেন, ভারতের সব টিভি চ্যানেল বাংলাদেশের শহরগুলি ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামসমূহেও দেখা যায়। বলতে গেলে, ভারতীয় সিনেমা ও সিরিয়ালের টানে বাংলাদেশি দর্শকদের অধিকাংশ বুঁদ হয়ে রয়েছে। এমনকী কোনও টিচার ছাড়াই বাংলাদেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও অবলীলায় আমাদের রাষ্ট্রভাষা হি¨ি শিখে ফেলেছে। অবশ্য বাংলাদেশিদের একটা দুঃখও রয়েছে, বাংলাদেশের চ্যানেলগুলি কলকাতা, অসম, ত্রিপুরায় উপলব্ধ নয়। আগে যখন দূরদর্শনের দাপাদাপি তখন অ্যান্টেনা ব্যবহার করে অনেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকগুলি দেখতেন। এখন বাংলাদেশি চ্যানেলগুলি বিলকুল গায়েব। তা সে যাইহোক, এখন বেশকিছু বাংলাদেশি ইউটিউব প্রোগ্রামে পাকিস্তানের নাটক, সিরিয়াল এবং সিনেমা দেখার জন্য ব্যাপক ওকালতি চলছে। এই সব প্রোগ্রামে বলা হচ্ছে, ধীরে ধীরে নাকি পাকিস্তানি নাটক, সিরিয়াল বাংলাদেশের দর্শক-শ্রোতাদের আকর্ষণ করছে। এর শুরু হয়েছিল নাকি লকডাউনে কোভিডের সময়। সারাদিন ঘরে বসে অনেকেই স্বাদ পালটানোর মতো পাকিস্তানি নাটক, সিরিয়াল দেখা শুরু করেন। ইদানীং তাতে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। ওই ইউটিউব অনুষ্ঠানগুলিতে ওকালতি করা হচ্ছে, ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়ালগুলি শাশুড়ি-বউমা কিংবা দুই জা-এর মধ্যে ঝগড়া, ষড়যন্ত্র বেশিরভাগ দেখানো হয়। দেখানো হয়, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বোল্ড সাহসী জীবন, শর্ট প্যান্ট, শিকল ছেঁড়া জীবন ইত্যাদি। এর নাকি খারাপ প্রভাব পড়ে সামাজিক ক্ষেত্রে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। ওকালতি চলছে যে, পাকিস্তানের টিভির সিরিয়ালগুলি তুলনামূলকভাবে অনেক সংযত, পারিবারিক মুসলিম মূল্যবোধ সম্পন্ন, পোশাক-আশাকেও শালীন। এ ছাড়া বাংলাদেশের টিভি দর্শকরা নাকি পাকিস্তানি নাটকের পরিবেশ ও মূল্যবোধকে খানিকটা আপন বলে চিহ্নিত করতে পারেন। এ ছাড়া পাকিস্তানি সিরিয়ালগুলি ইদানীং তাদের অভিনয় ও গুণমানে বিশ্বজুড়ে উপমহাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে এবং তারা এটাও প্রচার করছে কোন কোন পাকিস্তানি সিরিয়ালগুলি জনপ্রিয় এবং দেখলে আন¨ পাবেন ইত্যাদি।
এ দিকে পাকিস্তানিরা বোধহয় বাংলাদেশকে নতুন মৃগয়াক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে। ফেসবুকে প্রেম করে প্রেমিকার টানে পাক যুবকরা চলে আসছে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। পাকিস্তানের এক যুবক আলিম উদ্দীন সরাসরি চলে আসেন খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার বেলছড়ি ইউনিয়নের উত্তরপাড়ায়। ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ সেখানকার জনৈক আলি হোসেনের মেয়ে তৃতীয় বর্ষের কলেজ ছাত্রী তাহমিনা আকতারকে আলিম উদ্দীন রীতিমতো কলেমা উচ্চারণ করে বিয়ে করেন। এ ছাড়া খানিক আগে কোর্ট ম্যারেজও করে ফেলেন। তাহনিমার বাবা বলেন, ইসলামি রীতি-নিয়ম অনুযায়ী আমার মেয়েকে ওই পাকিস্তানি যুবকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। আমার মেয়ে এখন তার স্বামীর সঙ্গে পাকিস্তানে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবে। পাসপোর্ট ও ভিসা তৈরির কাজ চলছে। দেখা যাচ্ছে, এবার বাংলাদেশি প্রশাসনও সহযোগিতা করেছে। মাটিরাঙ্গা থানার ওসি তৌফিকুল ইসলাম সার্টিফিকেট দিয়েছেন, পাকিস্তানি ওই যুবকটি প্রেমের টানেই মাটিরাঙ্গায় এসেছে। তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য আমরা পাইনি।
প্রেমিক, প্রেমিকার এই মিলনকে স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে দেখতে হবে পাক-প্রেমের এই নজির আরও সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে কি না। পড়লে যে বাংলাদেশিদের আপত্তি নেই, তা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে।