অসম: ‘ব্লাড জিহাদের’ পর নয়া আমদানি ‘ফ্লাড জিহাদ’

- আপডেট : ৬ অগাস্ট ২০২২, শনিবার
- / 7
বিশেষ প্রতিবেদক: অসমে বিজেপি দলের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গুয়াহাটিতে এক প্রেস কনফারেন্সে ‘বহু মসজিদ মাদ্রাসা জিহাদের ঘাঁটি’ বলে মন্তব্য করার পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা একদিকে ইসলাম, মুসলিম সম্প্রদায় এবং মাদ্রাসার সঙ্গে সন্ত্রাসকে জুড়তে চেয়েছেন আবার ‘সব মুসলিম খারাপ নয়’ এই ধরনের কথা বলে কিঞ্চিৎ ভারসাম্য রক্ষারও চেষ্টা করেছেন।
অসমে প্রায় ৭০০ হাই মাদ্রাসাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হিমন্ত সরকারের নজর এখন অসমে যে ৮০০ কওমী বা খারিজি মাদ্রাসা রয়েছে সেগুলির দিকে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, অসমে কওমী মাদ্রাসা-সহ বেসরকারি মাদ্রাসা সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৫০০টি।
হিমন্ত এ সম্পর্কে সুর একটু নরম করে বলেছেন, মাদ্রাসার এই বড় সংখ্যা জিহাদি মাদ্রাসা সূচক নয়। আমাদের অভিযোগ হচ্ছে, অপরিচিত শিক্ষক ও ইমামদের সম্পর্কে। এরা কিছু মাদ্রাসাকে তাদের আশ্রয়স্থল করে নিয়েছেন। আমাদেরকে এই মাদ্রাসাগুলিকে খুঁজে বের করতে হবে। তিনি একথাও বলেছেন, সরকার এখনও পর্যন্ত পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া বা পিএফআই-এর সঙ্গে বিনষ্ট করা পাঁচ সন্ত্রাসী মডিউলের যোগাযোগ সরকার এখনও খুঁজে পায়নি।
তিনি আরও বলেন, একটা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রথমে মুসলিমদের সেন্টিমেন্টকে এই বলে উসকে দেওয়া হচ্ছে যে, তারা অসমে নির্যাতনের শিকার। পিএফআই এই প্রক্রিয়ায় মুসলিমদের মতবাদে দীক্ষিত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্পষ্ট করে আরও বলেন, কতজন বাংলাদেশী নাগরিক অসমে প্রবেশ করে এই ধরনের কার্যকলাপ চালাচ্ছে, আমরা তা সঠিকভাবে জানি না। তবে বাংলাদেশী নেতৃত্বে অসমে আরও সন্ত্রাসী মডিউল থাকতে পারে। কিন্তু সেগুলি আমাদের পুলিশের নজরে এখনও আসেনি। তিনি আবার ইসলাম বিরোধীদের একটি পুরনো তত্ত্ব তুলে ধরেন।
হিমন্ত বলেন, সমস্ত মুসলিমরা মৌলবাদী নয়। শান্তিপ্রিয় মুসলিমদের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা পাঁচটি সন্ত্রাসী মডিউল বিনষ্ট করতে পেরেছি।
ইসলাম বিরোধীদের পরিচিত তত্ত্বটি হচ্ছে, ‘সমস্ত মুসলিম সন্ত্রাসী নয়’, কিন্তু সমস্ত সন্ত্রাসী হচ্ছে মুসলিম।’ হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এরই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র। তিনি একদিকে বলছেন, পুলিশের কাছে বিস্তারিত কোনও তথ্য নেই। আর পুলিশ এও জানে না কতজন সন্ত্রাসী বাংলাদেশী নাগরিক অসমে ঢুকেছে। বোঝা যায়, তিনি অনুমান এবং কল্পনার বৃত্তে বন্দি হয়ে মুসলিম, মসজিদ, মাদ্রাসা, ইমাম সাহেব ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন। তবে মুখ্যমন্ত্রীর মতো পদাধিকারির মুখ থেকে এই ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা যে বিরাট গুরুত্ব পেয়ে যায় সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।
হিমন্ত খানিকটা করুণা করেই হয়তো বলেছেন, সব মুসলিম মৌলবাদী নয়। কিন্তু সাংবিধানিক পদাধিকারি হয়েও বজরং দল, রামসেনা, বিশ্ব হিন্দু, পরিষদ, গোরক্ষক বাহিনী এরা মৌলবাদী কি না সে ব্যাপারে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীজির কোনও বক্তব্য নেই।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত ‘অসমকে জিহাদের ঘাঁটি’ বলেছেন। কিন্তু কথিত জিহাদ করে জিহাদকারীরা কত সম্পদের ক্ষতি করেছে, কয়টি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বা নাশকতামূলক কাজ করেছে কিংবা তারা হত্যা কিংবা খুন-জখমে লিপ্ত হয়েছে তার কোনও তথ্য তিনি দিতে পারেননি।
মুসলিমদের সম্পর্কে আজগুবি কথাবার্তা অবশ্য অসমে নতুন নয়। হিমন্ত যখন কংগ্রেসের দাপুটে মন্ত্রী ছিলেন তখনও এই ধরনের নানা অভিযোগ উঠত। যেমন বলা হত, অসমের চর অঞ্চলে বাংলাদেশী হেলিকপ্টার নেমেছে, সেখানে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি।
এছাড়া অসমের জিহাদি দলগুলির নামও মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। যেমন ঈদগাহ প্রোটেকশন কমিটি, সাদ্দাম বাহিনী ইত্যাদি। এই সংগঠনগুলি নাকি অসমের জিহাদি সংগঠন। পরে অবশ্য এদের কোনও হদিশ কেউ পায়নি। ভারতের অনুগত এক বন্ধু দেশ বাংলাদেশ। সেখান থেকে কি করে জিহাদিরা এত তৎপরতা শুরু করেছে তারও কোনও সুলক-সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মসজিদ, মাদ্রাসা ভারতে এক হাজারের বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছে। তারা জিহাদি তৎপরতা করেছে এমন কোনও তথ্য ইতিহাসে নেই। তবে দেশের মাওলানারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের আজাদি সংগ্রামে ব্যাপকহারে অংশ নিয়ে ছিলেন, একথা অবশ্য সত্য। পিএফআই সম্পর্কেও হিমন্ত বলেছেন, সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনও যোগাযোগ পাওয়া যায়নি। তাও কিন্তু হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মহাশয় মুসলিমদের সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়াতে কসুর করছেন না।
মুসলিমদের সম্পর্কে ‘লাভ জিহাদ’ ‘করোনা জিহাদ’ এগুলি তো রয়েছে, হিমন্তের পুলিশ আর একটি নতুন জিহাদ আমদানি করেছে। তা হল ‘ফ্লাড জিহাদ’। অর্থাৎ অসমে যে বন্যা হয়েছে তার জন্য নাকি দায়ী এখনকার মুসলিমরা। শুধু মুখে প্রচার নয়, পুলিশ এ জন্য পাঁচজন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে। ১৫দিন জেলে থাকার পর প্রমাণ না থাকায় জামিন দিয়েছে। আর বুলডোজার দিয়ে ‘ব্লাড জিহাদ’-এর অভিযোগে মাদ্রাসা ভাঙার কাজও শুরু করেছে হিমন্তবাবুর পুলিশ বাহিনী।