৩০ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আর  কতদিন মণিপুর, নুহ্ ও মসজিদ দখল?

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ৬ অগাস্ট ২০২৩, রবিবার
  • / 8

এ হাসান:  বারাণসীতে অবস্থিত জ্ঞানভাপী মসজিদের বয়স ৩৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। সম্রাট আওরঙ্গজেব এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। ৩৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বাসীরা এখানে নামায আদায় করেছেন। পাশেই রয়েছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। ৩৫০ বছর ধরে মন্দির-মসজিদে উপাসনা বা ইবাদত করতে কোনও বাধা হয়নি। কিন্তু এখন বিজেপিরাজ বকলমে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বজরং দলের শাসন। কেবল আইনের শাসনই বিলকুল গায়েব। ভারতের পার্লামেন্টে ১৯৯১ সালে একটি আইন পাস হয়।

তাতে বলা হয়, একমাত্র বাবরি মসজিদ ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনাগৃহের যে চরিত্র ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ছিল, তাতে কোনও পরিবর্তন ঘটানো চলবে না।  অর্থাৎ যদি কোনও মসজিদ, গির্জা, গুরদোয়ারা ১৯৪৭ সালে যেমন ছিল,তার চরিত্র কোনোভাবে বদল করা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে আইন নয়, সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদই নয়া কানুন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গেরুয়া দলগুলির প্রধান গুরুরা বলেছিলেন, আমরা বাবরি মসজিদ পেয়ে গেলে অন্য কোনও দিকে নজর দেব না। আবার তাঁদেরই আর এক উগ্র দলের বক্তব্য ছিল, ‘বাবরি মসজিদ তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। আবার এদেরই আর এক অংশ ‘গবেষণা’ করে দাবি জানিয়েছিলেন, খণ্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশের ৩০ হাজার মসজিদ আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

দেখা যাচ্ছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা লোয়ার কোর্ট, হাইকোর্টে মামলা করছেন যে, কোনও মসজিদের ওযুস্থানের ফোয়ারা প্রমাণ করে যে, এটা নাকি ‘শিব লিঙ্গ’। আর পুরো মসজিদটাই হচ্ছে প্রাচীন মন্দির। তাঁদের দাবির সপক্ষে খনন করে বৈজ্ঞানিক সার্ভে করার জন্য নিম্ন থেকে শুরু করে শীর্ষকোর্ট আদেশ দিয়ে দিচ্ছে।

হায়দরাবাদের সাংসদ ওয়েইসি বলেছেন, এভাবে চললে হাজার হাজার মসজিদ কবজার এক ফ্ল্যাডগেট খুলে যাবে। আর সেদিকেই  এগোচ্ছে শাসক দল সমর্থিত বলদর্পী গেরুয়া উগ্রবাদীরা। কুতুব মিনার থেকে শুরু করে তাজমহলও তাঁদের নজরে রয়েছে। আর সেদিকেই তাঁরা এগোচ্ছেন। তাজমহল নাকি আসলে ছিল তেজমহালয়া। দখল করলেই কিছু তথা কথিত ইতিহাসবিদ ও মিডিয়া বিরাট প্রচারযজ্ঞ চালাতে থাকবে। পুলিশ-প্রশাসন তো সঙ্গেই রয়েছে। আদালতও হয়তো বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালিয়ে নানা নমুনা বের করার ইজাযত দিয়ে দেবে। তাহলে আর বাকি রইল কী?

আর  কতদিন মণিপুর, নুহ্ ও মসজিদ দখল?

বহু ইতিহাস বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আর তাঁদের মধ্যে আধুনিক হিন্দুধর্মের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন যে, পুরীর বিশাল মন্দির প্রাচীনকালে ছিল বৌদ্ধদের উপাসনালয়। পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা তাকে নাকি মন্দিরে পরিণত করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, পুরীর মন্দির যাতে হিন্দুরা খুবই পবিত্র ও শ্রদ্ধার স্থল বলে মনে করেন, সেখানে কী খনন করে বৈজ্ঞানিক সার্ভের দ্বারা সেটি আসলে বৌদ্ধদের ছিল না হিন্দুরাই তৈরি করেছিল, তা নির্ণয় করার অনুমতি দেওয়া হবে, কিন্তু না, এই অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। অতীত খুঁড়ে কান্না জাগানো কোনও মতেই কাম্য নয়। বৌদ্ধদের হাতে বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ‘বুদ্ধগয়ার মঠ’টি পুরোপুরি তুলে দিলেই ভারত ও বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা খুশি।

আর একটি প্রশ্ন এসে যায়, যেভাবে ভারতের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপর গুজরাত, মণিপুর, নুহ্ ও মেওয়াতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তা কি ইনসাফের পরিচয়বাহক, বাংলাদেশে এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে মন্দিরগুলির দখল নিলে কিংবা দিনের পর দিন মণিপুরের মতো সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হলে আমরা কী বলতাম, নিশ্চয়ই নিন্দা করতাম এবং পথে নামতাম।

হ্যাঁ, মণিপুর, নুহ্ ও গুরুগ্রামের জন্য আমাদের অর্থাৎ প্রত্যেক ভারতবাসীর প্রতিবাদ জানানো উচিত। আর মণিপুর বা নুহ্ নয়, ভারতে থাক সেই ‘বিভেদের মাঝে মিলন মহান’।

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

আর  কতদিন মণিপুর, নুহ্ ও মসজিদ দখল?

আপডেট : ৬ অগাস্ট ২০২৩, রবিবার

এ হাসান:  বারাণসীতে অবস্থিত জ্ঞানভাপী মসজিদের বয়স ৩৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। সম্রাট আওরঙ্গজেব এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। ৩৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বাসীরা এখানে নামায আদায় করেছেন। পাশেই রয়েছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। ৩৫০ বছর ধরে মন্দির-মসজিদে উপাসনা বা ইবাদত করতে কোনও বাধা হয়নি। কিন্তু এখন বিজেপিরাজ বকলমে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বজরং দলের শাসন। কেবল আইনের শাসনই বিলকুল গায়েব। ভারতের পার্লামেন্টে ১৯৯১ সালে একটি আইন পাস হয়।

তাতে বলা হয়, একমাত্র বাবরি মসজিদ ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনাগৃহের যে চরিত্র ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ছিল, তাতে কোনও পরিবর্তন ঘটানো চলবে না।  অর্থাৎ যদি কোনও মসজিদ, গির্জা, গুরদোয়ারা ১৯৪৭ সালে যেমন ছিল,তার চরিত্র কোনোভাবে বদল করা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে আইন নয়, সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদই নয়া কানুন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গেরুয়া দলগুলির প্রধান গুরুরা বলেছিলেন, আমরা বাবরি মসজিদ পেয়ে গেলে অন্য কোনও দিকে নজর দেব না। আবার তাঁদেরই আর এক উগ্র দলের বক্তব্য ছিল, ‘বাবরি মসজিদ তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। আবার এদেরই আর এক অংশ ‘গবেষণা’ করে দাবি জানিয়েছিলেন, খণ্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশের ৩০ হাজার মসজিদ আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

দেখা যাচ্ছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা লোয়ার কোর্ট, হাইকোর্টে মামলা করছেন যে, কোনও মসজিদের ওযুস্থানের ফোয়ারা প্রমাণ করে যে, এটা নাকি ‘শিব লিঙ্গ’। আর পুরো মসজিদটাই হচ্ছে প্রাচীন মন্দির। তাঁদের দাবির সপক্ষে খনন করে বৈজ্ঞানিক সার্ভে করার জন্য নিম্ন থেকে শুরু করে শীর্ষকোর্ট আদেশ দিয়ে দিচ্ছে।

হায়দরাবাদের সাংসদ ওয়েইসি বলেছেন, এভাবে চললে হাজার হাজার মসজিদ কবজার এক ফ্ল্যাডগেট খুলে যাবে। আর সেদিকেই  এগোচ্ছে শাসক দল সমর্থিত বলদর্পী গেরুয়া উগ্রবাদীরা। কুতুব মিনার থেকে শুরু করে তাজমহলও তাঁদের নজরে রয়েছে। আর সেদিকেই তাঁরা এগোচ্ছেন। তাজমহল নাকি আসলে ছিল তেজমহালয়া। দখল করলেই কিছু তথা কথিত ইতিহাসবিদ ও মিডিয়া বিরাট প্রচারযজ্ঞ চালাতে থাকবে। পুলিশ-প্রশাসন তো সঙ্গেই রয়েছে। আদালতও হয়তো বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালিয়ে নানা নমুনা বের করার ইজাযত দিয়ে দেবে। তাহলে আর বাকি রইল কী?

আর  কতদিন মণিপুর, নুহ্ ও মসজিদ দখল?

বহু ইতিহাস বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আর তাঁদের মধ্যে আধুনিক হিন্দুধর্মের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন যে, পুরীর বিশাল মন্দির প্রাচীনকালে ছিল বৌদ্ধদের উপাসনালয়। পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা তাকে নাকি মন্দিরে পরিণত করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, পুরীর মন্দির যাতে হিন্দুরা খুবই পবিত্র ও শ্রদ্ধার স্থল বলে মনে করেন, সেখানে কী খনন করে বৈজ্ঞানিক সার্ভের দ্বারা সেটি আসলে বৌদ্ধদের ছিল না হিন্দুরাই তৈরি করেছিল, তা নির্ণয় করার অনুমতি দেওয়া হবে, কিন্তু না, এই অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। অতীত খুঁড়ে কান্না জাগানো কোনও মতেই কাম্য নয়। বৌদ্ধদের হাতে বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ‘বুদ্ধগয়ার মঠ’টি পুরোপুরি তুলে দিলেই ভারত ও বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা খুশি।

আর একটি প্রশ্ন এসে যায়, যেভাবে ভারতের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপর গুজরাত, মণিপুর, নুহ্ ও মেওয়াতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তা কি ইনসাফের পরিচয়বাহক, বাংলাদেশে এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে মন্দিরগুলির দখল নিলে কিংবা দিনের পর দিন মণিপুরের মতো সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হলে আমরা কী বলতাম, নিশ্চয়ই নিন্দা করতাম এবং পথে নামতাম।

হ্যাঁ, মণিপুর, নুহ্ ও গুরুগ্রামের জন্য আমাদের অর্থাৎ প্রত্যেক ভারতবাসীর প্রতিবাদ জানানো উচিত। আর মণিপুর বা নুহ্ নয়, ভারতে থাক সেই ‘বিভেদের মাঝে মিলন মহান’।