আফরোজ আলম সাহিল
মোদি সরকার এক সময় ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ স্লোগান দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রয়োজন পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই স্লোগানটি যে নিছকই ফাঁকা আওয়াজ তা বুঝতে বাকি নেই কারও। চলতি মাসে পেশ হওয়া কেন্দ্রীয় বাজেট তা আরও একবার প্রমাণ হল।
বর্তমান বাজেট দেখাচ্ছে যে, মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদী আদর্শেই পরিচালিত হচ্ছে। দেশের সংখ্যালঘু যুবকদের শিক্ষা এবং উন্নয়নের বিষয়ে সরকার তেমন আগ্রহী নয়। বিশেষ করে প্রায় ২০ কোটি মুসলিম জনগণের ব্যাপারে তারা উদাসীন। আসলে সরকার দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে দেখিয়ে আসছে।
শিক্ষা প্রকল্পে বাজেট কাটছাঁট
২০২৫-২৬ সালের বাজেটে প্রথম যে শিক্ষা প্রকল্পটির বাজেট কমানো হয়েছে, তা হল সংখ্যালঘুদের জন্য প্রি-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সংখ্যালঘু উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ হয়েছিল ৫০২০.৫০ কোটি টাকা। এবারে তাতে কোপ পড়েছে বিরাট মাত্রায়। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বাজেটে সংখ্যালঘু উন্নয়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে ৩০৯৭.৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কমেছে ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া বাজেটে মাoাসা শিক্ষাতেও কমেছে বরাদ্দের অঙ্ক। আগে ছিল ১৬০ কোটি টাকা। ১৫০ কোটি কেটে তা হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। রাজনীতির কারবারিরা এটা বলছেন, কোনও সম্প্রদায়ের উন্নয়নে যদি কোনও ভাবনাচিন্তা থাকত, তাহলে নতুন কিছু ঘোষণা সামনে আনত কেন্দ্রের সরকার। কিন্তু তা বাজেটের ছবিতে দেখা গেল না। একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপের ক্ষেত্রে। ২০২৫-২৬ বাজেট ৬৫ শতাংশ কমিয়ে ৪১৩.৯৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রফেশনাল এবং টেকনিক্যাল কোর্সের জন্য মেধা-কাম-মিন্স স্কলারশিপের বাজেটও কমে মাত্র ৭.৩৪ কোটি টাকা হয়েছে, গতবছর যা ছিল ৩৩.৮০ কোটি টাকা।
বিদেশে পড়াশোনার জন্য শিক্ষা লোন সুদ সহায়তা প্রকল্পের বাজেটও কমিয়ে ৮.১৬ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা গতবছর ছিল ১৫.৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া, মাদ্রাসাগুলোর জন্য শিক্ষা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দও প্রায় ৯৩ শতাংশ কমিয়ে ০.০১ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা গতবছর ছিল ২ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ সালে ছিল ১০ কোটি টাকা।
ওয়াকফ প্রকল্পের জন্য বাজেট কমানো হয়েছে
ওয়াকফ সিস্টেমের জন্য বাজেটও কমানো হয়েছে। ২০২৩-২৪ সালে এই প্রকল্পের জন্য ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, যা ২০২৪-২৫ সালে কমিয়ে ১৬ কোটি টাকা করা হয়। এবার তা আরও কমিয়ে ১৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। এতদিন এইসব প্রকল্প মূলত ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার উন্নত করার জন্য বরাদ্দ ছিল।
সম্প্রতি পার্লামেন্টে ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনা চলছে। মোদি সরকার মুসলিমদের জন্য ওয়াকফ সিস্টেমের একটি সংশোধনী বিল উপস্থাপন করতে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য ওয়াকফ কাঠামোকে উন্নত করা। কওমি ওয়াকফ বোর্ড তরিক্কি প্রকল্প, ওয়াকফ বোর্ড দ্বারা পরিচালিত ওয়াকফ সম্পত্তির রেকর্ড ডিজিটাল বা কম্পিউটারাইজড করার ওপর গুরুত্ব দেয়। আরেকটি প্রকল্প হল শহরি ওয়াকফ সম্পত্তি বিকাশ যোজনা, যা ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান এবং ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে সুদ মুক্ত ঋণ প্রদান করে, যাতে ওয়াকফ সম্পত্তির বাণিজ্যিক উন্নয়ন হতে পারে। তবে, এই বছরের বাজেটে ওয়াকফ সম্পর্কিত প্রকল্পগুলির বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
এই ঋণগুলি মূলত শহরাঞ্চলে খালি ওয়াকফ জমিতে ব্যবসায়িক কমপ্লেক্স, ম্যারেজ হল, হাসপাতাল, কোল্ড স্টোরেজ ইত্যাদি আর্থিকভাবে লাভজনক ভবন নির্মাণের জন্য প্রদান করা হয়।
প্রথমে এই দুটি প্রকল্পের জন্য আলাদা বাজেট ছিল, কিন্তু ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বাজেট কমিয়ে উভয় প্রকল্পের জন্য একত্রিত করে দেয়। ২০২৩-২৪ সালে এই দুটি প্রকল্পের জন্য ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ৮ কোটি টাকা ছেড়েছিল মোদি সরকার। ২০২৪-২৫ সালে ১৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ৩.০৭ কোটি টাকা ছেড়েছিল সরকার। এই বছর, উভয় প্রকল্পের জন্য বাজেট আরও কমিয়ে ১৩ কোটি টাকা করা হয়েছে।
মূল প্রকল্পগুলি বন্ধ
মোদি সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, নই মানজিল (একত্রিত শিক্ষা ও জীবিকার উদ্যোগ), উস্তাদ (প্রথাগত শিল্প/কারুশিল্পের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ উন্নয়ন), সংখ্যালঘু মহিলাদের নেতৃত্ব উন্নয়ন প্রকল্প এবং হামারি ধরোহর (সংখ্যালঘু সংßৃñতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও সুরক্ষা) সকলই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, ইউপিএসসি-এসএসসি এবং রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে।
মাওলানা আজাদ শিক্ষা ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও আর্থিক কর্পোরেশন এর জন্য বরাদ্দ গতবছর শূন্য করা হয়েছিল। একই প্যাটার্ন এবারও পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
বাজেট ঘোষণা: নেপথ্যের গল্প ভিন্ন
২০২৫-২৬ সালের বাজেটে গতবছরের তুলনায় কিছুটা বাড়তি বরাদ্দ দেখা গেলেও প্রকৃত চিত্রটা ভিন্ন। বর্তমান বাজেট ৩,৩৫০ কোটি টাকার, যা গতবছরের ৩,১৮৩.২৪ কোটি টাকার তুলনায় ১৬৬ কোটি টাকা বেশি। তবে বিশদে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে, বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ প্রকল্পগুলোর বাজেট কমানো হয়েছে।
এ ছাড়া, এটা লক্ষণীয় যে, সরকার প্রাথমিকভাবে যে বাজেট ঘোষণা করে, তা পরে সংশোধন করে থাকে। যেমন, ২০২৪-২৫ সালে মাইনরিটি অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের জন্য সরকার ৩,১৮৩.২৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি কমিয়ে ১,৮৬৮.১৮ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়। এখন দেখার বিষয়, ২০২৫-২৬ সালের বাজেটের ৩,৩৫০ কোটি টাকায় আরও কোন পরিবর্তন আসবে কি না।
মাইনোরিটি অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের অধীন প্রকল্পগুলোতে ক্রমাগত কাটছাঁট করার ফলে মনে হচ্ছে, সরকার হয়তো মন্ত্রকটি বিলুপ্ত করার পরিকল্পনা করছে। ২০০৬ সালে সরকার একটি রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে মাইনরিটি অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রক প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে মুসলিমদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থান ভারতের অন্যান্য জনগণের তুলনায় অনেক পিছনে। সেই সময় এই মন্ত্রকটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির উন্নয়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তবে, সংখ্যালঘুদের সহায়তায় যে প্রকল্পগুলি ছিল, সেগুলোর জন্য বাজেট কমিয়ে দেওয়ার ফলে সরকারের কল্যাণ প্রতিশ্রুতি নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে। যদি এই কাটছাঁট চলতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এটি একটি ছক। যার উদ্দেশ্য ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত জনগণের জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলোকে দুর্বল ও ধ্বংস করা।