লিভ ইন সম্পর্কে নয়, বিবাহের মতো পবিত্র বন্ধনেই আস্থা রাখে ভারতীয় সমাজ

- আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার
- / 26
বিপাশা চক্রবর্তী: বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন বা বলা যায় একটি প্রতিষ্ঠান। যুগ যুগ ধরে নর-নারী এই পবিত্র সম্পর্কে আবব্ধ হয়ে আসছে। একজন নারী বা পুরুষের মিলিত এই বন্ধনের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি আস্থা, নিরাপত্তা, ভালোবাসার এক বুনিয়াদ গড়ে ওঠে। জীবনের চলার পথের চড়াই-উৎরাই পার করে একে অপরের হাত ধরে সম্পর্ক বয়ে চলে আপন গতিতে। কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘সঙ্গিনী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়, এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে, সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।’ তবে বিবাহের মতো সেই পবিত্র বন্ধনে এক পুরুষ আর নারী সেই হাতের উপর হাত রেখে সারাজীবন ভরসা, ভালোবাসার পথ চলতে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়।
তবে বর্তমান সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক নয়, নয়া প্রজন্ম। কারণ তাদের কাছে ‘বন্ধন’ এই শধটি নিয়ে বড় আপত্তি রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে সমাজে সবচেয়ে চর্চিত বিষয় লিভ টুগেদার, বা একত্রেবাস। যেখানে একজন সঙ্গী বা সঙ্গিনী তাদের পছন্দমতো পুরুষ বা নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপণ করে একসঙ্গে থাকতে পারেন। যে সম্পর্কে কোনও দায়বদ্ধতা, বোঝাপড়া নেই। মানসিক বা অর্থনৈতিক কোনও দায় স্বীকার করতে রাজি নয়, বর্তমান প্রজন্ম। শুধুই একে অপরের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা, আর নিজের খুশি মতো থাকার ইচ্ছা বা স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
যে সম্পর্কে আবেগের থেকে বেশি আছে, পরস্পরের উপস্থিতিকে উপভোগ করা। লিভ-ইন সম্পর্কে ‘উপভোগ’ শধটির একটি বিশেষ মানে আছে। কারণ এই সম্পর্কে একজনের সঙ্গে অপরের উপভোগ শেষ, আর সম্পর্কও শেষ! তবে এখানে একটা প্রশ্ন, যে সম্পর্ক কোনও দায়বদ্ধতা, নিরাপত্তা চায় না, শুধু চায় আনন্দ, একে অপরের সান্নিধ্য, একটা সময়ের পরে সেই ‘নিরাপত্তা’ই চেয়ে বসে এই সম্পর্ক। আর তখনই ভয়ঙ্কর পরিণতি নেমে আসে। দেখা গেছে এই ধরনের লিভ ইন সম্পর্কের হাত ধরে সমাজে বেশ কিছু নৃশংস ঘটনা ঘটে গেছে, যা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠেছে সমাজ।
সম্প্রতি একটি মামলার পর্যবেক্ষণে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট বলে, ‘মরশুমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঙ্গী বদল করার ধারণাকে একটি স্থিতিশীল সুস্থ সমাজের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। আদালত তার পর্যবেক্ষণে জানায়, বর্তমান সময়ে লিভ-ইন সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছে যুব সমাজ। কিন্তু এই প্রবণতা ভারতে বিবাহের প্রতিষ্ঠানকে ধবংস করছে।’
বিশেষজ্ঞরা বিবাহের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, বিবাহ এক নারী-পুরুষকে নিরাপত্তা দেয়। এই নিরাপত্তা শুধু যে অর্থনৈতিক সেটা নয়, মানসিক নিরাপত্তার জন্ম দেয়। দিনের শেষে দুটি মানুষের একসঙ্গে পাশে বসা, হাতে হাত রেখে পথ চলা এটিও একটি নিরাপত্তা। সেই সঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে যেকোনও আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে স্বামী ও স্ত্রীয়ের স্বাক্ষর প্রয়োজন। সেইসঙ্গে সন্তান জন্মানোর পর তার স্বীকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সব থেকে বড় কথা ভারতীয় সমাজ বিদেশের মতো পশ্চিমা নীতিতে বিশ্বাসী নয়। সেই কারণে অবাধ সেক্স, যৌনাচারকে ভারতীয় সমাজ সমর্থন করে না। এখনও এই সমাজে যৌথ পরিবারে ঠাকুমা-দাদু, ভাই-বোন অভিভাবকদের মধ্যে বেড়ে ওঠাই সমাজের রীতি। বিবাহ মানে শুধু একজন নর-নারীর মধ্যে প্রেমের বন্ধন নয়, দুটি পরিবারের মধ্যেও সম্পর্কের আদান-প্রদান।
হিন্দুশাস্ত্র মতে, বিয়ে শুধুই চুক্তি নয়, বরং একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। হিন্দু আইন মূলত হিন্দু ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিরূপায়ন। শাস্ত্রানুযায়ী পুরুষদের অবশ্য পালনীয় ১০টি ধর্মীয় কর্তব্যের অন্যতম হল বিয়ে। হিন্দু আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে হল, ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন। হিন্দু আইনানুযায়ী কনের বাবা-মা বরের হাতে কনেকে সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু বিবাহ শারীরিক মিলন ব্যতীত সম্পূর্ণ এবং বৈধ হিসাবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি শারীরিক মিলনের ঊর্ধ্বে দুটি আত্মার আত্মিক মিলন। এটি একত্রে দুটি পরিবারকেও যুক্ত করে।
পাশাপাশি ইসলাম ধর্মে বিবাহকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসেবে ধরা হয়েছে। বিয়ের আগে যৌনতা ইসলাম ধর্মে ‘হারাম’! ইসলামে এ হেন আচরণকে পাপ হিসেবেই ধরা হয়।
কেবলমাত্র বিয়ের আগে যৌনতাই নয়, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে, যৌন সঙ্গমকে মান্যতা দেয় না ইসলাম। বিয়ে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও রাসূল সা.-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। বিয়ে ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হল, ‘তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ বলা যেতে পারে, ইসলাম একমাত্র জীবনব্যবস্থা, যার বিশ্বসমাজ গড়ে তোলার মতো ঔদার্য ও সামর্থ্য আছে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে একটা বৃহৎ সমাজ গঠনের সব উপাদান ইসলামের মধ্যে নিহিত আছে।