সফিকুল ইসলাম (দুলাল)বর্ধমান: ‘বাংলা গানের বিস্মৃত যুবরাজ’ উপমাটি কে মল্লিককে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের শিরোনামে ব্যবহার করেছিলেন বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক ও লোকসাহিত্য বিশারদ আবুল আহসান চৌধুরী। ‘মল্লিক’ বলতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কথা ভুলে গিয়েও এখনও মনে রেখেছেন কিছু শ্রোতা। কিন্তু কে মল্লিক অচিরেই ‘বিস্মৃত’ হয়েছেন। অথচ, এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। উনিশ শতকের প্রায় গোড়া থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাংলা গানের জগতে নতুন অধ্যায় তৈরি করেছিলেন কে মল্লিক। জনস্বার্থে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মধ্যে সংগীতকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। গানকে মর্যাদা দিতে, মুন্সি মুহাম্মদ কাশেম থেকে হয়েছিলেন ‘কে মল্লিক’।
কলকাতার রাস্তায় গান গেয়েই চলেছেন এক নাম না জানা শিল্পী। হুঁশ ফেরে ইংরেজ পুলিশের তাড়া খেয়ে। গোটা রাস্তা তখন অবরুদ্ধ। সেই জ্যামে আটকে পড়েছেন জার্মান রেডিয়ো বেকা কোম্পানির মালিকও। তিনি অখ্যাত এই শিল্পীকে সরাসরি অফার করেন তাঁর কোম্পানিতে গান করার। কাশেম তখনকার দিনে তিনশো টাকা রয়্যালটি পেলেন। যেহেতু হিন্দু ভক্তিগীতি গাইতে হবে তাঁকে, তাই কাশেম নামের কে এবং শুভার্থী গোরাচাঁদ মল্লিক এবং শান্তি মল্লিকের পদবি মল্লিক ব্যবহার করে তাঁর নাম রাখা হল ‘কে মল্লিক’। সাধারণত এই ঘটনা আমরা টিভি বা সিনেমায় দেখে থাকি। কিন্তু বাস্তবে এই ঘটনা ঘটেছিল কে মল্লিকের জীবনে। বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার মন্তেশ্বর থানার কুসুমগ্রামে ১৮৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন খোদাবক্স ওরফে কাসেম ওরফে কে মল্লিক।
কাশেমের চাচাতো ভাই ইব্রাহিম মুন্সি ওই এলাকার প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। ভাই কে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। সে-কারণে তাঁকে পাঠাতে চাননি কলকাতায়। কিন্তু হঠাৎই কলেরায় ইব্রাহিম মুন্সির মৃত্যু হলে কাশেম ও তাঁর পরিবার আচমকাই অভাবের মধ্যে পড়েন। জমিদারবাড়িতে গান শেখাতে আসতেন সংগীতশিল্পী সতীশ চক্রবর্তী। কাশেম সেখানে গান শিখতে শিখতে সতীশবাবুর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন। নিতান্ত বালক বয়সে সতীশবাবুর সঙ্গেই একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কাশেম কলকাতায় আসেন। কাশেমের গানের গলা ভালো, আগ্রহ ততোধিক।
কলকাতার তুলাপট্টিতে চামড়ার গুদামে সামান্য মাইনেতে কাজ পেয়েছিলেন কাশেম। অমানুষিক পরিশ্রম। দুর্গন্ধে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত। খালি গলায় গুনগুনিয়ে খোদাবক্স কানপুরের এক শাস্ত্রীয় সংগীত ওস্তাদের নজরে পড়েন। তিনি তাঁকে কানপুরে নিয়ে যান এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম দেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে কে মল্লিক ওরফে কাশেম কলকাতায় ফিরে আসেন। বন্ধু-বান্ধব হিতাকাঙ্ক্ষীরা অনেকেই বলেছিলেন, অসাধারণ হিন্দু শাস্ত্রীয় সংগীত গাইলেও কেবল নাম তাঁর জনপ্রিয়তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। ফলে নাম পালটে তিনি হয়ে যান কে মল্লিক। এমনটা সেই সময়ে নতুন ছিল না। জনপ্রিয় তারকা অভিনেতা মুহাম্মদ ইউসুফ খান দিলীপ কুমার হয়েছিলেন। মমতাজ জাহান দেহেলভী হয়েছিলেন মধুবালা। সাইরা আলি হয়েছিলেন রীনা রয়û। মেহজাবিন বানু হয়েছিলেন মীনা কুমারী। বদরুদ্দীন জামালউদ্দিন কাজী হয়েছিলেন জনি ওয়াকার। এমন বহু নাম রয়েছে। তেমনভাবেই কাশেম কে মল্লিক হয়েছিলেন।
নজরুল ১৯২৮ সালে এইচএমভি-র সঙ্গে চুক্তি করার পর কে মল্লিক প্রথম যে দু’টি নজরুলসংগীত গেয়েছিলেন, সে দু’টো হচ্ছে— ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ এবং ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’। রেকর্ড প্রকাশের সঙ্গেই হিট। নজরুলের প্রচুর গান গেয়েছেন কে মল্লিক। তাঁর সঙ্গে কবির ভালো সম্পর্কও ছিল। নজরুলের গান তিনি কে মল্লিক, কাশেম আবার মুহাম্মদ কাশেম নামেও গেয়েছেন। তবে সর্বাধিক গেয়েছেন কে মল্লিক নামেই।
১৯০৯-১৯৪৮, এই পর্বে সংগীতশিল্পী কে মল্লিক পৌঁছন খ্যাতির শিখরে। তাঁকে নিয়ে রেকর্ড কোম্পানিগুলির কাড়াকাড়ি। থিয়েটার, নাটক, রেডিয়ো সর্বত্রই গান গেয়েছেন। নলিনী সরকার নিজের খাতায় নজরুলের লেখা গান গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়ে আসেন। কে মল্লিক তাঁর থেকে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ এবং ‘আমার চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’ গান দু’টি তুলে রেকর্ড করতেই বাজিমাত।
বিভিন্ন রেডিয়ো কোম্পানিতে গান গেয়ে সেই কোম্পানি ফুলে-ফেঁপে উঠলেও তিনি লাভবান হননি। খুবই দুঃখে জীবনের শেষলগ্নে তিনি আবার কুসুমগ্রাম গ্রামে ফিরে আসেন। সেখানে গ্রামবাসী ও স্থানীয় কৃষকদের বিনা পয়সায় গান শোনাতেন। সেই সময়কার বিখ্যাত শিল্পী ইন্দুবালা, কৃষ্ণ ভিমানী, গওহর জানদের সঙ্গে কে মল্লিকের নাম মানুষের মুখে মুখে ফিরত।
একসময় অভিমানে কলকাতা থেকে তিনি ফিরে আসেন কুসুমগ্রামে। ১৯৬১ সালে ইন্তেকাল করেন এই সাড়া জাগানো শিল্পী।