অর্পিতা লাহিড়ী: ২০১৮ সালের ১৭ জুন পেট্রাপোল সীমান্তে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে যখন নো ম্যানস ল্যান্ড পায়ে হেঁটে পার করছি যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের উদ্দেশ্যে। ওপারে তখন পৌঁছে গিয়েছে আমাদের শ্যামলী পরিবহনের বাস। হটাৎ শরীর জুড়ে একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম। আত্মা বোধহয় বলতে চাইলো কাঁটাতার কি সব ভাগ করতে পারে? সে কি পারে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসিমউদ্দীনকে ভাগ করতে? আজ বরং সে কথা থাক। ২৫ বৈশাখের পবিত্র পুণ্য প্রভাতে শুনিয়ে যাই আমার শিলাইদহ ভ্রমণের অনুভবের টুকরো গাথা।
রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে মিলেমিশে আছে আজকের বাংলাদেশের তিনটি স্থান— শিলাইদহ, শাহাজাদপুর বা সাজাদপুর আর পতিসর। শিলাইদহ পর্বে কবি লিখেছেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, ক্ষণিকার অসংখ্য কবিতা। লিখেছেন অর্ধশতাধিক ছোটগল্প আর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীকে অনন্য পত্রগুচ্ছ। ‘পদ্মা’ বোটে ভেসে বেড়িয়েছেন পদ্মা নদীর ওপর। যখন থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব আসে তখন থেকেই মনে মনে উত্তেজনা তৈরী হয়েছিল। মনে এসেছিল শিলাইদহতে বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত সেই কুঠিবাড়ী এবং লালন সাইজির মাজার দর্শনের ইচ্ছা।
অগ্রজপ্রতিম বাংলাদেশ বেতার ও দূরদর্শনের শিল্পী তথা বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার ইউনুস আলি মোল্লা সাহেব সেই ইচ্ছা পূরণ করালেন। তাঁর ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরের বাসাতেই আমরা ছিলাম অতিথি হিসেবে। অপরূপ বাংলার সৌন্দর্য দু চোখ জুড়িয়ে দেয়। পথে যেতে যেতেই স্মরণ করি দুই বাংলার আরও এক পরম প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ-কে। মন যেন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে—
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
পৃথিবীর রূপ আমি খুঁজিতে
যাই না আর।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কুমারখালি উপজেলার অর্ন্তগত শিলাইদহ ইউনিয়নের খোরেশদপুর এই কুঠিবাড়ি অবস্থিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, ইত্যাদি, গীতাঞ্জলী কাব্যের অনুবাদ কাজও শুরু করেন।
১৯৫৮ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব দফতরের ব্যবস্থাপনায় শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িটি গৌরবময় স্মৃতিরূপে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুঠিবাড়িটির গুরুত্ব অনুধাবন করে কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি সংগ্রহশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুরো ভবনটি এখন সংগ্রহশালা হিসেবে দর্শকদের জন্যে উম্মুক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ১৬টি কক্ষেই কবি রবীন্দ্রনাথ, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কৃষক বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অর্থাৎ নানা বয়সের বিচিত্র ভঙ্গির রবীন্দ্রনাথের ছবি। বাল্যকাল থেকে মৃত্যুশয্যার ছবি পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। তাছাড়াও রয়েছে শিল্পকর্ম এবং তাঁর ব্যবহার্য আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো।
কবি ভবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলোর মধ্যে আরও আছে ‘চঞ্চলা’ ও ‘চপলা’ নামের দুটো স্পিডবোট, পল্টুন, আট বেহারা পালকি, কাঠের চেয়ার, টী-টেবিল, সোফাসেট, আর্ম চেয়ার, পালংক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস। অবিরাম বেজে চলেছে রবীন্দ্রসংগীত। মন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে—
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’….
সময় এগিয়ে চলে। ইউনুস দাদা তাড়া দেন, লালন সাইজি যেতে হবে। পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসি বারান্দায়। বর্ষাস্নাত সোনারোদ মাখা সবুজ শিলাইদহ উন্মুক্ত হয় চোখের সামনে। সেই বিখ্যাত বোটের রেপ্লিকা। সময় যায়, বেরিয়ে আসতে হয়। ভিজিটর বুকে লিখলাম—
‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়, বিদায়ের পাত্রখানি
আর কি বা করতে পারি গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো ছাড়া।’
সংগ্রহশালার গেটের পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার, জনপ্রতি টিকিটের দাম পনের টাকা করে, তবে পাঁচ বছরের কম কোনও বাচ্চার জন্যে টিকিটের দরকার পড়েনা। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের জন্য প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ টাকা। সার্কভুক্ত বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে টিকিট মূল্য পঞ্চাশ টাকা এবং অন্যান্য বিদেশী দর্শকদের জন্য টিকিটের মূল্য একশো টাকা করে।
বন্ধ-খোলার সময়সূচী
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কুঠিবাড়ি খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত আধ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ থাকে। আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর সবসময়ের জন্যেই শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার সাধারণ ছুটি এবং সোমবার বেলা ২.০০ থেকে খোলা থাকে। এছাড়াও সরকারী কোন বিশেষ ছুটির দিনে বন্ধ থাকে সংগ্রহ শালা
কি ভাবে যাবেনঃ
ঢাকার গাবতলি,মাজার রোড থেকে শ্যামলী, হানিফ, রয়্যাল পরিবহনের বাসে ( এসি) সরাসরি কুষ্টিয়া। ভাড়া পড়ে মোটামুটি ৮০০ টাকা। কুষ্টিয়াতে থাকার জন্য প্রচুর হোটেল পাবেন। সেখানে রাত্রিবাস করে পরদিন একটা ইজিবাইক (আমাদের টোটো বা ই রিক্স) করে পাড়ি দিন স্বপ্নের শিলাইদহের পথে। আর হ্যাঁ যাওয়ার পথে গড়াই নদীর সঙ্গে আলাপটা সেরে নিতে ভুলবেন না।