পুবের কলম প্রতিবেদক : বীরভূমের বগটুই গ্রামে এখন শশ্মানের নিরবতা। স্বজনহারাদের চোখে-মুখে শুধু কান্না, আতঙ্কের ছাপ। ঘুম-খাওয়া তাঁদের কাছে এখন বিলাসিতা। নৃশংস এই ‘হত্যাকাণ্ডে’র যথাযথ তদন্ত ও দোষীদের কঠোরতম শাস্তি চাইছেন স্বজনহারাদের পরিবার।
বুধবার গ্রামে সাংবাদিকরা ঢুকতেই তাঁদের ক্যামেরার সমানে কান্নায় ভেঙে পড়লেন এক মৃতদের পরিজনরা। এমন ঘটনা যে ঘটবে তা তাঁরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। মা, দিদি,জামাইবাবুকে হারানো এক যুবতীও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শোকে পাথর হয়ে বললেন, নিজে সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলে বেঁচে গিয়েছেন। মা’য়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। বলতে বলতে ফের কান্না, ধরে এল গলা। রামপুরহাট থানার পুলিশের বিরুদ্ধেও একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন। বললেন, ‘রামপুরহাট থানার পুলিশের উপর ভরসা নেই। সিবিআই তদন্ত চান। ২ দিনের জন্য স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলেন নানুরের বাসিন্দা মাজিদুর রহমান। রামপুর হাটের বকটুই গ্রামে সোমবার প্রাণ গিয়েছে তাঁরও। তাঁর পরিবারের দাবি, ‘ন্যায় বিচার চাই।’
বগটুই গ্রামে একই পরিবারের যে আট জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের একজন ভাসান শেখের মা মীনা বিবি। বাকিরাও ভাসানের নিকট আত্মীয়। কাকিমা, পিসি, ভাগ্না-ভাগ্নী। ফলে, কী ভয়ংকর মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বীরভূমের এই যুবক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভাসান শেখের অভিযোগ, মা মীনা বিবিকে পুড়িয়ে মারার আগে ওরা তাড়া করেছিল। মা প্রাণ ভয়ে দৌড়াতে থাকে। ওদের হাতে ছিল কুড়ুল । ঘরে ঢুকে মাকে হাঁফাতে দেখে ভাগ্নারা জল বাড়িয়ে দেয়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঘরে ঢোকে। এলোপাথাড়ি কোপায়। সকলের গায়ে কেরোসিন-পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে তাঁর। জানালেন, পরিবারের এক সদস্যের উপস্থিতিতে দাফনকাজ সম্পন্ন হয়েছে। পরিবার-পরিজন হারিয়ে শোকার্ত ভাসান শেখের একটাই আর্তি, যারা এতবড় অন্যায় করেছে, যারা এতগুলো খুন করেছে, তাদের শাস্তি চাই।
স্বজন হারানো আর এক ব্যক্তি মিহির লাল। সরাসরি অভিযোগ করলেন তৃণমূলের ব্লক সভাপতির নেতৃত্বে হামলা হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে বাড়ির ভেতর থেকে তালা দেন মহিলারা। হামলাকারীরা তখন বাইরে থেকে দাহ্য পদার্থ জাতীয় কিছু নিক্ষেপ করে ঘরের দেওয়ালে। ধরিয়ে দেয় আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে বাড়ি। পরিবারকে শেষ করে দিল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। পুলিশ কোনও সাহায্য করেনি। পুলিশ দাঁড়িয়ে হত্যালীলা দেখেছে। জীবন্ত অবস্থায় পুড়িতে দেখেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
শেখ লাল, তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের বাড়িতেই হামলা চলেছিল। কান্না চেপে জানালেন, তাঁর মাকেও জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলতে গিয়েই গামছা দিয়ে চোখ মুছলেন। এঁরা প্রত্যেকেই এখন গোপন আস্তানায়। বগটুইয়ে যে বাড়িগুলিকে সোমবার রাতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের আত্মীয়দের অনেকের এখনও খোঁজ মেলেনি। তিনি আরও জানান, সোমবার রাত ৮ কি সাড়ে আটটা। বগটুইয়ের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হন। তখন সাময়িক একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। তারপর সাড়ে ন’টা থেকে শুরু হয় বোমাবাজি। প্রচুর বোমা পড়তে থাকে। ফটিক, সে আমার চাচাতো ভাই, ওর বাড়িতে বোমা পড়ে। ফটিকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। আর ওর বউকে গ্রিল কেটে বার করে এনে কোপাল ওরা। কোপের পর কোপ তারপর যখন মরে গেল, তখন পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিল ও পুড়ল। তারপর দ্বিতীয় বাড়িতে অ্যাটাক করল। সেটা সোনার বাড়ি। ভয়ে যেখানে তারা লুকিয়ে ছিল, সেখানেই আগুন ধরাল ওরা। একটা বাড়িতে ছ’জন জন মেয়ে – ছেলে লুকিয়ে ছিল, আর এক জন পুরুষ ছিল। গ্রিল কেটে বার করে এনে একটা ঘরে ঢুকিয়ে জ্বালিয়ে দিল ওরা। সারা রাত ধরে আগুন জ্বলল। পুলিশ কোনও খোঁজই নিল না। বেলা ১২টায় পুলিশ এলো। বাইরে থেকে ওরা গ্রিল কেটে ঢুকে আগুন ধরিয়েছে। সোনার বাড়িতেই সব শেষ। দমকল যখন এসেছিল সব শেষ। আমার ভাই, তার মেয়ে, জামাই, নাতনি সব শেষ।
তদন্তের জন্য এদিন ঘটনাস্থলে যায় ফরেন্সিক টিমও। তাদের রিপোর্টে উঠে এসেছে, ঘর রক্তে ভেসে গিয়েছিল। বিভিন্ন ঘরে মিলেছে পোড়া রক্তের নমুনা। একটি লোহার রড থেকে আঙুলের ছাপও নিয়েছে তারা। একটি প্লাস্টিকের জার মিলেছে অকুস্থল থেকে। ঘরের দক্ষিণ পূর্ব কোণে প্রথম আগুন লেগেছিল বলেও উঠে এসেছে ফরেন্সিক রিপোর্ট।
জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের পর এবার জাতীয় মহিলা কমিশনও রামপুরহাটের ঘটনায় রিপোর্ট তলব করল। রাজ্য পুলিসের ডিজি মনোজ মালব্যকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে বলেছেন কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা। দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে কড়া শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। ডিজির পাশাপাশি বুধবার চিঠি দেওয়া হয়েছে বীরভূমের পুলিস সুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীকেও।
বগটুই আজ পুরুষ শূন্য। ভারী বুটের আওয়াজ আর গ্রামে জনপ্রতিনিধিদের ভিড়। সোমবারের রাতে যাঁদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাঁদের পরিবারের সদস্যদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, তাঁদের কোনও একজনকেও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই বাড়ির কেউ কেউ পালিয়ে গিয়েছিলেন আগেই। তাই বেঁচে গিয়েছিলেন। অনেকে আতংকে গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছেন।
এদিকে, রামপুরহাট কাণ্ডে এবার শাস্তির মুখে ১২ জন সিভিক ভলান্টিয়ার ও এক গোয়েন্দা প্রধান। কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ তুলে তাঁদের সাসপেন্ড করলেন বীরভূমের পুলিশ কমিশনার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠি। ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনের তরফে রামপুরহাটের ঘটনার রিপোর্ট পৌঁছেছে নবান্নে। ঘটনার সূত্রপাত সোমবার রাতে। ওইদিন রামপুরহাটে বোমা মেরে খুন করা হয় তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখকে। এর পরই সেই রাতে বগটুই গ্রামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যেখানে অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসনের দাবি।