‘মিস্টার পারফেক্ট’ হওয়ার তাগিদে এক অনুভূতিহীন দেশে পরিণত জাপান
বিশেষ প্রতিবেদন: নিঃসঙ্গতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা জাপানকে দেখলে বোঝা যায়। উন্নত, প্রগতিশীল এই দেশে বিগত ছয়মাসের মধ্যে একা, নিঃসঙ্গ অবস্থায় ৪০ হাজার বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে তাদের পচা-গলা দেহ উদ্ধার হয়েছে। ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়, পরিবার-পরিজন ছাড়া কতখানি কষ্টের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তাদের। এই নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন।
বিশ্বের মধ্যে অন্যতম উন্নত দেশগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে জাপান। সারা বিশ্বের মধ্যে এই দেশে গড় আয়ু সর্বাধিক এবং শিশু মৃত্যুর হার তৃতীয়, সর্বনিম্ন। জাপানের মানুষ খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ। সেই সঙ্গে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই দেশ। কিন্তু সেই উন্নয়নের মধ্যে আছে বিষাদের সুর। কারণ এই দেশের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবস্থা খুব ভালো নেই, এককথায় বলা যেতে পারে খুব অসহায় অবস্থায় দিন কাটে তাদের। জীবনের শেষ দিনগুলিতে কাউকে পাশে পায় না তারা।
২০২৪ সালে সেই করুণ চিত্র সামনে এসেছে, যা সত্যিই হৃদয় বিদারক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে একা বাড়িতে থাকার সময় কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনা এতটাই মর্মান্তিক যে, অনেক সময় মৃত্যুর পর দেহ পড়ে রয়েছে অথচ পরিবারের লোকেরা কিছু জানে না। পচা-দুর্গন্ধ বের হওয়ার পর আশেপাশের লোকেরাই খবর দিচ্ছে পুলিশে। জাপানের মতো প্রগতিশীল দেশের এই অবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছেও একটি বিচলিত করে দেওয়ার মতো ঘটনা।
রাষ্ট্রসংঘের মতে, দেশটিতে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের বাস। তাদের বেশিরভাগই নিজ বাড়িতে একা থাকতে বাধ্য হন।
দেশটির ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সির তথ্য অনুসারে, অন্তত ৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর এক মাসেরও বেশি সময় পরে জানা গেছে। আর এক বছর ধরে নিখোঁজ থাকার পর ১৩০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এত আধুনিক, অত্যাধুনিক দেশে এই ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে মোট ৩৭ হাজার ২২৭ জনকে একাকী বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ৬৫ বা তার বেশি। এদের মধ্যে ৭ হাজার ৪৯৮ জনের বয়স ৮৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি। ৭৫ থেকে ৭৯ বছর বয়সির সংখ্যা ৫ হাজার ৯২০। ৭০ থেকে ৭৪ বছর বয়সি ৫ হাজার ৬৩৫টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাপানের সরকারি টিভি চ্যানেল জানিয়েছে, যে মরদেহগুলোর খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি, সেগুলো খুঁজে বের করতে পুলিশ সেই তথ্য সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।
জাপানি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি রিসার্চ বলেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটিতে একা বসবাসকারী বয়স্ক নাগরিকদের যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি সেই সংখ্যা ১ কোটি ৮০ হাজারে পৌঁছাবে। তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের বিভিন্ন পরিবারে ১ কোটি ৮ লক্ষ বয়স্ক মানুষ একা, নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসবাস করবে। মোট পরিবারের হিসাবে এটি ২০ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার।
জাপানি তরুণ-তরুণীদের দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতা বা অনেকের সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। ফলে জনসংখ্যাগত সংকটের মুখে পড়েছে জাপান। সেখানে চিকিৎসা ও কল্যাণ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বিপরীতে কমছে শ্রমশক্তি।
রাষ্ট্রসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবীণ জনসংখ্যা পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান। জাপান ছাড়া চিন ও দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যাও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জাপানে জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার বেশি, যা বিশ্বের তৃতীয়-বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এছাড়াও, জাপান বিশ্বের সর্বোচ্চ আয়ুর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যে কারণে দেশটিতে প্রবীণ জনসংখ্যা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
ক্রমবর্ধমান শ্রম ঘাটতি মোকাবিলায় এবং স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার আশায়, জাপান সরকার গত এক দশকে প্রবীণ এবং ঘরে অবস্থানরত মায়েদের পুনরায় কাজে যোগদান করতে উৎসাহিত করেছে। আর সরকারের সেই বার্তা কিছুটা কাজেও দিয়েছে, জাপানে বর্তমানে রেকর্ড ৯.১২ মিলিয়ন প্রবীণ কর্মী রয়েছেন এবং টানা ১৯ বছর ধরে এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এ বছরের শুরুর দিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি রিসার্চ এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, জাপানে একাকী বসবাসকারী প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা আগামী ২৫ বছরের মধ্যে অনেক বৃদ্ধি পাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটির প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে একা একা জীবন কাটাতে হতে পারে।
১৯৮০র দশকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠার পর থেকে জাপানের জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য নারীদের প্রজনন বছরগুলোতে গড় সন্তান জন্মের হার জনপ্রতি ২.১ থাকা প্রয়োজন হলেও, জাপানে তা কমে মাত্র ১.৩-এ নেমে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাপানি তরুণ-তরুণীদের দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতা বা অনেকের সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে।
দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্য ও ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে এশিয়ার উন্নত দেশ জাপান। লাভ হচ্ছে না কোনও। নিঃসঙ্গতা দিন দিন বেড়েই চলেছে দেশটিতে।
প্রসঙ্গত, উদীয়মান সূর্যোদয়ের দেশ! প্রযুক্তিগত উন্নয়নের রোল মডেল! পৃথিবীর সব চাইতে সভ্য জাতি! জাতিগত ভাবেই জাপানিরা ভীষণ সুশৃঙ্খল, সৌন্দর্য প্রিয়। যাকে বলা যায় ডেডিজ ব্লু আইড বয় বা মায়ের ভালো ছেলেদের দেশ। বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা এই দেশকে নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই।
শৈশব থেকে তাদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বহুকাল থেকেই তাদের মধ্যে কঠোর অনুশাসন চলে আসছে। শৈশবে জাপানি মেয়েদের পায়ের সৌন্দর্য রক্ষায় লোহার জুতা পায়ে দিতে হত। আধুনিকতার কারণে সেই সমস্ত নিয়মের নয়া মোড়ক জুড়েছে। জাপানের জীবনযাত্রা মানবিকের বেশি যান্ত্রিক। এক অনুভূতি শূন্য জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। ‘গুডবয়’ বা ‘মিস্টার পারফেক্ট’ উপাধি পেতে তাদের কালের বা সময়ের গর্ভে নৈবেদ্য সাজাতে হয়েছে কিছু মানবিক আবেগ অনুভূতির।
নিজেদের সভ্য মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে বেছে নিতে হচ্ছে যন্ত্রণা দায়ক যন্ত্র জীবন। জাপানিরা কাঁদতে ভুলে গেছেন, কাজের চাপের ক্লান্তিতে পারিবারিক আড্ডা ভাবের আদান প্রদানের অনিহা বাড়ছে। সব চাইতে পরিছন্ন শহর উপাধি পেতে তাদের শিশুদের দিতে হয় নিয়মিত ßুñল শেষে বাড়তি শ্রম। তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘ সময় কাজ শেষে বাড়ি যাবার সময় আগ্রহ হারিয়ে অফিসিয়াল পোশাকে রেল বা বাস স্টেশনে রাত কাটাচ্ছেন। কারণ পরের দিন সেই একঘেয়ে রুটিন। সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক বার্ধ্যক্য। বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকেই ইচ্ছে করেই কারাগারে যেতে চায় ছোটখাট অপরাধ করে। এ দেশে প্রতি বছর দুই লক্ষ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ফলে অনেক পরিবারেই আছে শুধু একজন। সেখানে পিতা কিংবা মা’কে একা একাই সন্তানকে বড়ো করতে হয়।