গুয়াহাটি, ৪ সেপ্টেম্বরঃ অসমে বসবাসকারী বাংলাভাষী মুসলিমদের নিরাপত্তার কিছুই অবশিষ্ট নেই, সেটা বেশ কিছুদিন ধরে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নানা বিভাজনমূলক মন্তব্যে স্পষ্ট হচ্ছিল। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, উজান অসমে মিঞা (বাংলাভাষী মুসলমান)-দের না যাওয়াই ভালো। সরকার তাদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারবে না। এমনকি বিধানসভায় দাঁড়িয়েই তিনি মিঞা তথা নিম্ন অসমের মুসলিমদের তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলেই দাগিয়ে দেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরপরই একসঙ্গে ২৮ জন নিম্ন অসমের বাংলাভাষী মুসলমানকে ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছেন বরপেটার পুলিশ সুপার তথা মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাই সুশান্ত বিশ্ব শর্মা। পুলিশের দাবি, বিদেশি শনাক্তকরণ ট্রাইব্যুনাল এদেরকে অনেক আগেই বিদেশি ঘোষণা করেছে। পুলিশ শুধু ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাদেরকে গ্রেফতার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে চালান করে দিয়েছে।
ঘটনাটি ঘটে সোমবার বিকেলে নিম্ন অসমের বরপেটা জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। আচমকা খবর আসে বরপেটা জেলা পুলিশ ২৮ জনকে গ্রেফতার করে এনেছে। তাদেরকে গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়ায় নবনির্মিত ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিতে হবে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের বাসে করে ২৮ জন বন্দি’কে নিয়ে গোয়ালপাড়ার ডিটেনশন ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় বরপেটা জেলা পুলিশ। বন্দিদের সেই বাসের আগে-পিছে ছিল পুলিশের এক বড় কনভয়।
২৮ জন বন্দির মধ্যে ৯ জন মহিলা। এঁরা হলেন মনোয়ারা বেগম, আইমানা খাতুন, সাবিয়া খাতুন, আজবা বেগম, বসাতন নেহা, ইতন নেছা। এছাড়া যে ১৯ জন পুরুষ রয়েছেন তাঁদের বয়স ৩০ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে। বরপেটা জেলা পুলিশ জানিয়েছে, এই জেলার ১১টি বিদেশি শনাক্তকরণ ট্রাইব্যুনালে তাদেরকে বিদেশি বলে অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়। যদিও পুলিশ এতদিন তাঁদের কোনও খোঁজ করেনি কে তার কোনও উত্তর নেই। দিনকয়েক ধরে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মিঞা বিরোধী নানা মন্তব্য শোনার পরপরই সোমবার হঠাৎই তাদেরকে ধরে জেলাপুলিশ সুপারের দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণই মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ সুপার ভাই সুশান্ত বিশ্ব শর্মার নির্দেশে তাঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন বন্দিদের নিকটাত্মীয়রা।
উল্লেখযোগ্য বিষষ হল, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল যাঁদের বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে, তাদের সকলেরই ১৯৬৬ থেকে ’৭১— এই সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড রয়েছে। তাঁরা নিয়মিত ভোট দিয়ে আসছেন। অনেকের পরিবারের ১৯৭১ সালের আগে জমির দলিলপত্রও আছে। এছাড়াও আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বন্দিদের বাবা-মা, তাঁদের ভাই-বোন ভারতের নাগরিক। অথচ তাঁরা বিদেশি! কী করে এমন অদ্ভূত কাণ্ড ঘটে? এর কোনও সদুত্তর পুলিশ কিংবা ট্রাইব্যুনালের কাছে নেই।
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসমের সীমান্ত পুলিশ বেছে বেছে বেছে কিছু মানুষের নামে সন্দেহভাজন বিদেশি নোটিশ পাঠাচ্ছে। আর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তাদের একতরফা বিচারে বিদেশি ঘোষণা করে দিচ্ছে। যারা হাইকোর্টে মামলা করে আইনি লড়াই চালাতে পারছেন, তারা ভারতীয় ঘোষিত হয়ে যাচ্ছে। আর যাঁরা অর্থের অভাবে মামলা লড়তে পারছেন না, তারা ‘বিদেশি’ চিহ্নিত হয়েই থাকছেন। ২০১৬ সালে বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাভাষী, বিশেষ করে নিম্ন অসমের মুসলিমদের নির্বিচাারে বিদেশি নোটিশ পাঠানো শুরু হয়। ডিটেনশন ক্যাম্পে তাদের উপর শুরু হয় ব্যাপক দমনপীড়ন। এর জন্য ৩১ জন বন্দির করুণ মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে ২৯ জনই বাঙালি হিন্দু। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল তিন মাসের বেশি কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি রাখা যাবে না, তাদের সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোন দেশে পাঠাবে? তারা তো বংশগতভাবে ভারতীয়। তাছাড়া, বাংলাদেশ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ভারতে তাদের কোনও নাগরিক নেই। তাই তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পেই মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২৬ আগস্ট অসম বিধানসভায় স্বরাষ্ট্র বিভাগের তথ্যে বলা হয়, রাজ্যে এই মুহূর্তে ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৫৭০ জন ‘ডি’ বা সন্দেহ জনক ভোটার আছে। এদের মধ্যে ৫৪,৪১১ জনকে বিদেশি ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল। অথচ ১৯১৭ সালের পর এখন অবধি মাত্র ১৬ জন ঘোষিত বিদেশিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাঙালি মানে বাংলাদেশি বলে বিজেপি যে প্রচার চালায়, তা কতটা মিথ্যা, সরকারি তথ্যে তা স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিধানসভায় মিঞা মুসলিমদের অবৈধ বিদেশি আখ্যা দেওয়ায় পরিণতি যে ভয়াবহ হবে, তা আগেই আন্দাজ করছিলেন পর্যবেক্ষক মহল। এবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের প্রতিহিংসা মেটানোর রাজনীতি শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।