আহমদ আবদুল্লাহ: বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে দু’টি রাষ্ট্র খানিকটা হলেও বিপত্তির মধ্যে পড়েছে। রাষ্ট্র দু’টি হল ভারত এবং বাংলাদেশ। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, ভারতে শেখ হাসিনা রয়েছেন নয়াদিল্লির কোনও সেফ হাউসে। এমনকি নয়াদিল্লিতে অবস্থানকারী বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর পদস্থ আধিকারিক তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদও শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এর প্রতিবেদন ও ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা তাঁর কন্যার সঙ্গে থাকছেন। বহালতবিয়তে তাঁরা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করছেন এবং পার্কেও নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই খবরটি ভারত ও বাংলাদেশের বহু গণমাধ্যমে উদ্ধৃত হয়েছে।
তবে কয়েকদিন আগে ভাইরাল হওয়া এক টেলিফোন বার্তায় শোনা গেছে, শেখ হাসিনা তাঁর দলের এক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বলছেন, তিনি তাঁদের খুব কাছেই রয়েছেন। এ কথাটি অর্থ দু’রকম হতে পারে। এক, তিনি যে স্থানে অবস্থান করছেন তা বাংলাদেশের খুব নিকটে। আবার এও অর্থ হতে পারে, মনের দিক থেকে তিনি বাংলাদেশের খুব কাছে রয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হল, শেখ হাসিনা আগামী দিনগুলিতে কোথায় অবস্থান করবেন? তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ইউকে, ইউএসএ, ইউএই বা আরব আমীরাতে। কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলি তাঁকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। তাই হাসিনা ভারতেই রয়ে গেছেন। হাসিনা অবশ্য তাঁর পিতার হত্যার পর দীর্ঘদিন ভারতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর নয়াদিল্লি থেকেই তিনি ঢাকায় আসেন এবং রাজনীতি শুরু করেন। সেই হিসেবে শেখ হাসিনার নয়াদিল্লিতে থাকা নতুন কিছু নয়। তবে পার্থক্য হচ্ছে, এবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেই সরাসরি ভারতে চলে এসেছেন।
বাংলাদেশ এখন গণতান্ত্রিক সংস্কার চাইছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর পুলিশ-প্রশাসনকেও পুর্নগঠিত করার প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলিও এখনই নির্বাচনের কোনও দাবি তুলছে না। তারা বরং ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই সময় দিতে চাইছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও খুব স্বাভাবিক হয়নি। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, যেভাবে আন্দোলন মুখে হঠাৎ সরকার পরিবর্তন হয়েছে এবং তা হয়েছে ছাত্র-সহ বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন হবে। তারা পুলিশ-প্রশাসনের অস্থিরতা দূরীকরণের জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এই বাণিজ্যিক সম্পর্কে ছেদ পড়লে ভারতের তো বটেই সবথেকে বেশি ক্ষতি হবে কিন্তু বাংলাদেশের। ভারতীয় পণ্য ও কাঁচামালের উপর ঢাকা অনেকটাই নির্ভরশীল।
কিন্তু বাংলাদেশে দাবি উঠেছে, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে তাঁকে বিচারের জন্য সোপর্দ করতে হবে। তাদের মতে শেখ হাসিনা যেভাবে স্বৈরাচারী শাসন চালিয়েছিলেন, তাতে বহু মানুষ খুন ও গুম হয়েছে। এছাড়া হয়েছে পিলখানা হত্যাকান্ড এবং শাপলা চত্বর গণহত্যা। এছাড়া বেশকিছু টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাকে হাসিনা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। তাই শেখ হাসিনার বিচার চাই।
কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে নয়াদিল্লির প্রত্যর্পণ চুক্তি সত্ত্বেও নয়াদিল্লি কখনই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেবে না। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যা ও সংশ্লিষ্ট নানা অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনা বরাবরই ভারতের পরম মিত্রের ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের কাছে যে সুবিধাগুলি দাবি করেছিল, শেখ হাসিনা তার প্রত্যেকটি পূরণ করেছেন। এ জন্য তাঁকে অবশ্য বিরোধী দলগুলির ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কোনও কিছুর পরোয়া করেননি। এই ধরনের মিত্র নয়াদিল্লির আর দ্বিতীয়টি নেই। ভুটানও ভারতকে এতটা সহযোগিতা করেনি। কাজেই শেখ হাসিনা ভারতের কাছে এক বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। তাই ঢাকা যদি সরকারিভাবে দাবি জানায়, তাহলেও ভারতের পক্ষে কখনই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।
অবশ্য একা মোদি সরকার নয়, কংগ্রেস আমলেও মুজিব কন্যা হাসিনার প্রতি একই ধরনের প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল নয়াদিল্লির। বিশেষ করে প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার ছিল আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক। প্রণববাবু সারা জীবন এই সম্পর্ক পালন করে গেছেন।
তাই শেখ হাসিনার জন্য নিরাপদ কোনও ব্যবস্থা না করে নয়াদিল্লি কখনই এই ধরনের মিত্রকে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য যে ঢাকার হাতে তুলে দেবে না তা একেবারে নিশ্চিত।
আর এদিকে বাংলাদেশে খানিকটা হলেও শেখ হাসিনার পক্ষে কেউ কেউ মুখ খুলছেন। মুখ খুলছেন স্বয়ং অন্তর্বর্তকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। তাঁদের একজন হচ্ছেন ইউনূস সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়া জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামি লিগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। আওয়ামি লিগের লোকের রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারেন। শেখ হাসিনাও আইন মেনে দেশে ফিরে আসতে পারেন।
আওয়ামি লিগের পক্ষে মুখ খুলেছেন আর এক প্রভাবশালী উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। শেখ মুজিবের ছবি তাঁর ড্রয়িং রুমে লাগানো রয়েছে। তিনি বলেন, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না যে, শেখ মুজিব ও আওয়ামি লিগের নেতৃত্বেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। আসিফ নজরুল ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের প্রবল বিরোধী। কিন্তু তিনি যে এখন সুর বেশ খানিকটা নরম করেছেন, তা তো স্পষ্ট।
আর এখনও আওয়ামি লিগের বাংলাদেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা কিছুদিন নীরব থেকে নিশ্চয়ই আবারও সরব হবেন। আর বাংলাদেশে থেকে যাওয়া এইসব আওয়ামি লিগ নেতা ও কর্মীরা এখনও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকেই তাঁদের নেত্রী বলে মনে করেন। অবশ্য এছাড়া আওয়ামি লিগের কাছে অন্য কোনও বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা ছাড়া তাঁদের কাছে অন্যকোনও ব্যক্তিত্ব নেই যিনি আওয়ামি লিগের ভাঙা নৌকায় মেরামত করে দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
কাজেই ঢাকা যদিও শেখ হাসিনার দিন পুরোপুরি ফুরিয়েছে বলে মনে করে কিন্তু বাস্তবে তাদের মূল্যায়ণ সঠিক নাও হতে পারে। বর্তমানে ডা. ইউনূস সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লি কাজ করতে চাইলেও শেখ হাসিনার গুরুত্ব কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। ভারতে বসে শেখ হাসিনাও তাঁর দলীয় কর্মীদের বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরে নানা নির্দেশিকা প্রদান করে চলেছেন। আর সেগুলি হয়তো ইচ্ছে করে ভাইরাল করা হচ্ছে। আর সেই সুবাদে শেখ হাসিনার বক্তব্য পৌঁছে যাচ্ছে আওয়ামি লিগের কর্মীদের কাছে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তর্বর্তী সরকারের পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে সেখানে অবস্থিত জনজাতিদের অশান্তি নতুন করে শুরু হয়েছে। এখনও বাংলাদেশের পুলিশের উপর জনগণের আস্থা ফিরে আসেনি। পুলিশও হাসিনা আমলে ব্যাপক অত্যাচার ও দুর্নীনি মদদ দেওয়ার পর জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে। তবে পুলিশ-প্রশাসনকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য চেষ্টা হচ্ছে। আর তাতে কিছু সাফল্যও পাওয়া গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আভ্যন্তরীণ অশান্তির মোকাবিলা করতে সেনাবাহিনীর হাতে বৈচারিক ক্ষমতা অর্পণ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলছে। যদিও বিশ্বব্যাঙ্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঢালাও আর্থিক সাহায্য দেওয়া কথা জানিয়েছে। কিন্তু সে দেশে হঠাৎ বন্যার পর সরকারকে সব গুছিয়ে নিয়ে অবশ্যই সময় লাগবে। কিন্তু আবারও বলব, শেখ হাসিনা এখনও আওয়ামি লিগের নেত্রী। তাঁর আবেদন ভারতের কাছে এখনও ফুরিয়ে যায়নি। অন্যদিকে আওয়ামি লিগের কাছেও শেখ হাসিনা ছাড়া বিকল্প কোনও নেতৃত্ব নেই। তাই দক্ষিণ এশিয়ার রঙ্গমঞ্চে শেখ হাসিনা অবশ্যই এখনও এক শক্তিশালী ঘুঁটি।