জমিদাতাদের মুখ্যমন্ত্রী যে প্যাকেজ দিয়েছেন, তা নজিরবিহীন: পি বি সালিম
কৌশিক সালুই, বীরভূম: বেঙ্গল গ্লোবাল সামিটের প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশি-বিদেশি প্রতিনিধিদের সামনে ঘোষণা করেছিলেন, বাংলার বীরভূমে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লার ভাণ্ডার। আর বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ট্যুইটে আরও বলেছেন, এখানে যে কয়লা রয়েছে তা বাংলার শিল্প ভবিষ্যতের প্রবাহকে ব্যাপক প্রসারিত করবে। তিনি অশোকনগরে তেল উত্তোলনের বরাত দিয়ে বলেছেন, অশোকনগর ভারতের পেট্রোলিয়াম ম্যাপে বাংলাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। তিনি শেষে বলেছেন, বিশ্ব বাংলার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা কাজের দ্বারা সফল করেছেন। বাংলা এখন শিল্প বিপ্লবের জন্য তৈরি রয়েছে।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর শুক্রবার মেশিনের সাহায্যে মাটি খুঁড়ে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়ে গেল পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম কয়লা প্রকল্প দেউচা পাঁচামিতে। সেখানে রাজ্য পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (ডব্লিউবিপিডিসিএল)-এর চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি বি সালিম, সাংসদ সামিরুল ইসলাম, জেলাশাসক বিধান রায়, জেলা পুলিশ সুপার আমনদ্বীপ এবং বরাত পাওয়া ঠিকাদার সংস্থার শীর্ষকর্তাদের উপস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি এই কাজ শুরু হয়ে গেল।
এ সম্পর্কে পি বি সালিম বলেছেন, দেউচা পাঁচামিতে মাইনিংয়ের কাজ শুক্রবার শুরু হয়ে গেল। সামান্য কিছু সমস্যা ছিল, তা সমাধান করা হয়েছে। আমি এবং এমপি সামিরুল ইসলাম সাহেব রয়েছি। রয়েছেন এখানকার জেলাশাসক, এসপি-ও। এখন এখানে সকলের সহযোগিতায় সুন্দরভাবে কাজ চলছে।
পিডিসিএল-এর চেয়ারম্যান আরও বলেন, দেউচা পাঁচামি কয়লা খনির পুরো নাম ‘দেওয়াঙ্গি হরিসিঙ্গা কোল ব্লক’ এটা হচ্ছে সারা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তর কয়লা খনি। এখানে ১,২০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা আছে। ২,৬০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ব্যাসাল্ট রয়েছে। এখানে ব্লক অ্যালট করা আছে পিডিসিএল-কে। আমরা আরআর প্যাকেজ নিয়ে গত তিন বছর ধরে কাজ করে আসছি। আমরা কাজ করেছি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের আস্থা অর্জন করে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে কাজ করেছি। আমরা ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষের লিখিত সম্মতিপত্র নিয়েছি। ফলে এখানে খননের জন্য যে বাধা ছিল, তা দূর হয়েছে। আর একটা কথা বলব, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যে পুনর্বাসন প্রকল্প ঘোষণা করেছেন তার থেকে ভালো পুনর্বাসন প্রকল্প সারা পৃথিবীতে নেই। প্রতি বিঘা পিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে ১৩ লক্ষ টাকারও বেশি। আর প্রত্যেক পরিবারের একজন সদস্যকে দেওয়া হচ্ছে পুলিশ কনস্টেবল, গ্রুপ ডি-র মতো সরকারি চাকরি। এ ছাড়া এখানে ভাগচাষী, পাট্টাদার, মজুর খাটেন সবার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। মানুষ সন্তুষ্ট হয়েছে। তাদের অঙ্গীকার পেয়েছি বলেই আমরা এখানে কাজ চালু করতে পেরেছি। আমাদের রাজ্যে যে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের রয়েছে, তার থেকেও এটা অনেক বৃহত্তর প্রকল্প। এখানে ৪৮৩০টি বাড়ি রয়েছে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী ২৩ হাজার মানুষ এখানে রয়েছে। তার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি রয়েছে আদিবাসী, এ ছাড়া রয়েছে এসসি, মাইনোরিটি ইত্যাদি সম্প্রদায় রয়েছে। এখন সবাই জমি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। সবাই চাইছে এখানে ইন্ডা্স্ট্রি হোক। সেই হিসেবে এই কাজ করা সম্ভব হয়েছে। এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং জব। এই মাইনটা প্রথমে দেওয়া হয়েছিল কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডকে। এটা আমাদের দেশের মধ্যে সবথেকে বড় কোল কোম্পানি, যারা কয়লা উত্তোলনে বিশেষজ্ঞ। তারা ১০ বছর এখানে কোনও কাজ করতে পারেনি। ২০১৩ সালে কোল ইন্ডিয়া স্যারেন্ডার করে কয়লা খনি সরকারকে ফেরত দেয়। ২০১৩ এরপর ৬টি রাজ্যের জয়েন্ট ভেঞ্চারকে ৬ বছরের জন্য দেওয়া হয়। তারা ৬ বছর রেখে ২০১৯ সালে স্যারেন্ডার করে ফেরত দেয় কেন্দ্র সরকারকে। তারপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ডব্লিউবিপিডিসিএল-কে চিহ্নিত করল তার ফাইনালি আমরা পেলাম ২০২১ সালের আগস্ট মাসে। তারপর আমরা সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করেছি। যার জন্য আজ আমরা সাফল্যের সঙ্গে কয়ল উত্তোলনের কাজের সূচনা করেছি। পি বি সালিম আরও বলেন, এটা চ্যালেঞ্জিং তার কারণ, কয়লা আছে ৩০০-১০০০ মিটার নিচে। এই ৩০০ মিটারের মধ্যে ৮০-২০০ মিটারের গভীরে ব্যাসাল্ট আছে। তার উপর ১০-৩০ মিটার মাটি আছে। মাটি কেটে, ব্যাসাল্ট কেটে তারপর কয়লা তুলতে হবে। শুক্রবার শুরু হল ওপেন কাস্ট মাইনিং। আন্ডারগ্রাউন্ড কোল মাইনিংয়ের জন্য গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হয়েছে ২৩ ডিসেম্বর। লাস্ট ডেট ৩ মার্চ। দেশ-বিদেশের অনেক কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা থেকে অনেক কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। যেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং সম্ভব হবে না সেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন করা হবে, গ্যাস হিসেবে তোলা হবে। ৫ রকমের গ্যাস উৎপন্ন হবে। যেমন নাইট্রোজন, মিথেন, কার্বন মনোস্কাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া। এইসব গ্যাস শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হবে।
দুটি পে লোডার এবং ডাম্পার দিয়ে মাটি খুঁড়ে সেই মাটি সরানোর মাধ্যমে দেউচা পাঁচামি কয়লা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর স্থায়ীভাবে কাজ শুরু হল এ দিন। রাজ্য, জেলা এবং বরাত পাওয়া সংস্থার শীর্ষকর্তাদের উপস্থিতিতে সেই কাজ শুরু হল। কয়লা প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় এলাকার সাধারণ মানুষের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্প শুরু হওয়ার বিষয়ে ঘোষণার দু’দিন পরেই স্থায়ীভাবে সেই কাজ শুরু হল।
বৃহস্পতিবার যেখানে ভূমি পূজন এবং মাটি কাটার কাজ আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছিল সেখানে স্থায়ীভাবে মাটি তোলার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। এ দিন স্থানীয় মানুষদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ইতিমধ্যেই ৭০০০ জনের বেশি এই প্রকল্পে জমি দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় আবেদন করেছেন। এখনও পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার জন পুলিশ এবং গ্রুপ ডি-তে চাকরি পেয়েছেন। বাকিদের নথি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে oুত গতিতে। এ ছাড়াও পর্যায়ক্রমে জমি মালিকদের কাছ থেকে ঘোষিত মূল্য দিয়ে জমি কেনার কাজও চলছে, জোরকদমে। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় কিছু মানুষজন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় এসে তাদের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবিদাওয়ার কথা জানান। সেই দাবিমতো এ দিন চাঁদা, গাবার বাথান, সাগর বাঁধি এবং মথুরা পাহাড়ি গ্রামে জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা ক্যাম্প করে সেই সমস্ত সমস্যার সমাধানের উদ্যোগী হয়েছেন। ১০টি মৌজায় এই প্রকল্পের কয়লা উত্তোলন করা হবে। প্রশাসন পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে যে সমস্ত বহু প্রাচীন গাছ আছে তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। এখনও পর্যন্ত ২৪ জন বাসিন্দাকে কালো পাথর তোলার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে বরাত পাওয়া সংস্থার সঙ্গে। যে সমস্ত শ্রমিকরা কাজ করতে ইচ্ছুক তাদেরকে সরাসরি প্রশাসনের কাছে নাম নথিভুক্ত করার জন্য আবেদন করা হয়েছে।
রাজ্যসভার সাংসদ তথা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সামিরুল ইসলাম বলেন, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত স্বপ্নের দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্প বাস্তবে রূপ পেল। দিদিকে আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই একইসঙ্গে পূথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা খনি প্রকল্পের অগ্রগতিতে দেউচা পাঁচামি এলাকা-সহ গোটা বীরভূমের মানুষকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।