পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: অতিথি দেবো ভব। এই জ্ঞানেই অতিথিকে সেবা করে ভারত। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে দিল্লি পালিয়ে এলে অতিথিকে আশ্রয় দিতে কোনও ভুল করেনি মোদি সরকার। ইউনূস সরকার বার বার প্রত্যর্পণের দাবি জানালেও তাতে পাত্তা দেয়নি কেন্দ্র। দিল্লির লুটিয়েনস বাংলোয় বহাল তবিয়তে তাকে রাখা হয়েছে। সূত্রের খবর, ইচ্ছেমতো শাড়ি, খাবার জোগান দেওয়া হচ্ছে তাকে। মাঝে মাঝে স্মার্টফোন মারফত আওয়ামি লিগ কর্মীদের চাঙ্গা করতে গরম গরম ভাষণও দিচ্ছেন তিনি। ‘কাছাকাছিই আছি, টুক করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ব, তোরা তৈরি থাক’— এমন মন্তব্যও করেছেন মুজিবকন্যা হাসিনা। প্রতিবেশী দেশের পলাতক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে এত যত্নআত্তি করার পরও ‘দুর্নাম’ জুটছে ভারতবাসীর কপালে। মোদি সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনা, এমনই অদ্ভুত দাবি করছে কয়েকটি বাংলাদেশি মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছেন একশ্রেণির মানুষ। যেকোনওভাবেই ‘অতিথি’ হাসিনাকে রক্ষা করা হবে— এমনটাই পণ রয়েছে কেন্দ্র সরকারের। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর সমালোচনায় সরব। তাদের দাবি, শেখ হাসিনার দুঃশাসন এবং লুটপাটের প্রকৃত ঘটনাগুলো যত প্রকাশিত হবে, বিপদ ততই বাড়বে মোদি সরকারের। হাসিনার দোষগুলো ভারতের রাজনীতিকে কলুষিত করবে বলে মনে করেন ওই তথাকথিত বিশ্লেষকরা। একটি বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম বলছে, ‘হাসিনার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে ভারতের মিডিয়া এবং উগ্রহিন্দুত্ববাদীরা যে মিথ্যাচার করছে, সেই সত্যও আজ দেশটির বিবেকবান সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ নাগরিকরা উপলব্ধি করছেন। তারা হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের হুমকি উপেক্ষা করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারতের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অধিকাংশই হাসিনা প্রশ্নে সরকার অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দল বিজেপিকেই অনুসরণ করছে। ভারতের জনগণের একটি বিরাট অংশও সত্যের পক্ষে বত্তৃ«তা-বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছে।’
বাংলাদেশি মিডিয়া ও নেটিজেনদের অভিযোগ, শেখ হাসিনাকে খুব মর্যাদাপূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে ভারতে আশ্রয় দেয়নি মোদি সরকার। গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বিজেপি সরকার নাকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অপমান করেছে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে ভারতকে ছোট করেছে। গত ২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাননি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টকে আশ্রয় দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব এই ঘটনা। এভাবেই ভারতকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম।
সরকারি পদমর্যাদা ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি বিবেচনায় ভারতের ভিভিআইপিরা বিভিন্ন ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন, যার মধ্যে ‘জেড প্লাস প্লাস’কেই সর্বোচ্চ বলে ধরা হয়। শেখ হাসিনার জন্য কেন্দ্র এখন ঠিক কোন ধরনের নিরাপত্তা প্রটোকল অনুসরণ করছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষস্থানীয় এক কর্তাকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা ইঙ্গিত দেন। তিনি ছোট তিনটি বাক্যে এ প্রশ্নের যে উত্তর দেন, ‘বেয়ার মিনিমাম, প্লেন ক্লদস, নো প্যারাফারনেলিয়া!’ এর অর্থ হলো, যেটুকু না হলে নয়, শেখ হাসিনাকে সেটুকু নিরাপত্তাই দেওয়া হয়েছে, সাদা পোশাকের রক্ষীরাই তার চারপাশে ঘিরে রয়েছেন, কমান্ডো বা সেনারা নন। ঢাকঢোল পিটিয়ে বা ঘটা করে তাকে কোনও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, বরং পুরো জিনিসটাকে খুব নিচু স্তরে বেঁধে রাখা হয়েছে, এমনটাই দাবি একাধিক বাংলাদেশি মিডিয়ার। দিল্লির লোদি গার্ডেনে তিনি এসে মাঝেমাঝে হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন কিংবা ইচ্ছে করলেই নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় কাওয়ালি শুনে আসছেন— এ ধরনের যাবতীয় জল্পনা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মকর্তারা! তার মানে বিজেপি সরকারের গলার কাঁটা হাসিনা! এভাবেই আজগুবি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশি মিডিয়া। তাকে যে অতিথিসেবা দিয়ে রাজধানীতে রাখা হচ্ছে লুটিয়েনসের মতো বিলাসবহুল জায়গায়, তার কোনও তারিফ তারা করছে না। তারা সমালোচনা করার জন্যই বলছে, হাসিনা নাকি মোদি সরকারের গলার কাঁটা! অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, গিলতেও পারছে না, ফেলতও পারছে না। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপও নাকি বাড়ছে।
তবে ও পি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত দাবি করেছেন, ‘মূলত দুটি কারণে ভারত শেখ হাসিনাকে রাখতে চায় না। প্রথম বিষয়টি অবশ্যই তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত। দ্বিতীয় বিষয়টি হল, বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, ভারত তার সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। আর বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। ভারত চায় না, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনায় ছায়াপাত করুক।’ পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, হাসিনা ইস্যুতে মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা দিন-দিন কমছে। কিন্তু এসব বলে খুব একটা লাভ নেই। অতিথি হিসেবে তিনি যতদিন থাকতে চান থাকবেন। যেমনভাবে বসবাস করছেন বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।