বিশেষ প্রতিবেদক: বেশকিছু মোক্ষম প্রবাদ রয়েছে বাংলা ভাষায়। তার একটি হল, ‘দুবৃত্তের ছলের অভাব হয় না’। আর একটি প্রবাদ হল, ‘বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ৩৬ ঘা’। প্রবাদে যা নেই তাহল, গেরুয়া পরিধানকারী যোগী ছুঁলে কমপক্ষে ৭২ ঘা।
দেশের শীর্ষ আদালতের আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা কিংবা সংবিধানে লিখিত বিভিন্ন ধারা এবং তার চেতনা কোনও কিছুই মোদি-যোগীরা মানতে রাজি নন। তাঁরা তাঁদের গেরুয়া এজেন্ডা বাস্তবায়িত করবেনই। তাঁরা যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা করে তাঁদের নির্বাচনের বিজয় রথের জন্য দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করেছেন, তার তুলনা একমাত্র বর্বর রাষ্ট্র ইসরাইলে পাওয়া যায়।
জার্মানির হিটলারও ইহুদিদের এত নিষ্ঠুরভাবে টার্গেট করেননি। যদিও এই সম্পর্কে নানা গল্প-কাহিনী সত্যকে ছাড়িয়ে মিথ্যাকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হল সম্ভল মসজিদ। উত্তরপ্রদেশের সম্ভল মসজিদ নিয়ে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে রায়ের ভিত্তিতে, ‘মসজিদের নিচে মন্দির আছে কি না’, তার সার্ভের জন্য একটি বিভাগের লোক-লস্কর পাঠানো হয়। তাঁরা সার্ভে করেন।
মসজিদ কমিটি তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। কিন্তু সার্ভে হয়ে গেলেও ফের আবার সম্ভল মসজিদে পুনরায় সার্ভে করে মন্দির বের করার বরাত দিয়ে তাঁদেরকে পাঠানো হয়। এবার সম্ভলের মুসলিমরা প্রতিবাদ জানান। যোগীর পুলিশ জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৫ জন তরতাজা মুসলিম তরুণকে হত্যা করে। আহত হন অনেকে।
এই ঘটনার দু-একদিন পর পুলিশ উত্তপ্রদেশের আর একটি মসজিদে বুলডোজার চালিয়ে এক অংশ ভেঙে দেয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এভাবে বুলডোজার চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, কোনও মসজিদের তলায় মন্দির আছে দাবি করে নিম্ন আদালত সার্ভে কিংবা খনন কাজের আদেশ দিতে পারবে না।
সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান ও সুবিচারের চেতনাকে বজায় রাখার জন্য আদেশ দিলেও গেরুয়া সরকার তা মানতে রাজি নয়। ভারতের মুসলিমদের হতমান অপমান করলেই নাকি তারা এখন এবং আগামীতে ‘নির্বাচন বৈতরণী’ পার হতে পারবে। অবশ্য ইউপি-তে লোকসভা নির্বাচনে এই সাম্প্রদায়িক তত্ত্ব ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে ঝাড়খণ্ডেও।
কিন্তু সংঘ পরিবার মনে করে, উন্নয়ন-বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র বিমোচন এগুলি তাদের কাছে বড় ইস্যু নয়। তাদের ইস্যু মুসলিমদের উপর অত্যাচার ও তাদের হতমান করা এবং বিদ্বেষের বেড়াজালে সংখ্যালঘুদের ঘিরে ফেলা।
সম্ভলে মুঘল যুগের পুরাতন একটি মসজিদে সার্ভের সময় গুলি চালিয়ে মুসলিম তরুণদের হত্যার কথা এখন সর্বজনবিদিত। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সম্ভল মসজিদে আপাতত কোনও অ্যাকশন নেওয়া যাবে না। কিন্তু যোগীজি কি ছাড়বেন? তাঁর প্রশাসন আদেশ দিয়েছে, ওই মসজিদের আশেপাশে কিংবা লাগোয়া যত দোকানপাট রয়েছে সবগুলি ভেঙে ফেলতে হবে। যোগীর জেলাশাসক রাজেন্দ্র পেনসিয়া-র অভিমত হল, এগুলি নাকি জবর দখল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সম্ভল মসজিদের কাছাকাছি দোকানগুলিকে উচ্ছেদের নোটিশ দিয়ে জেলাশাসক বলেছেন, এরা বিদ্যুৎ চুরি করে আর এরা জবর দখলকারী। তাই এরা সরে না গেলে চলবে বুলডোজার। পর্যবেক্ষকদের মতে, মুসলিমদের হতমান করার জন্য তাদের রুজি-রোজগার বন্ধ করার লক্ষ্যে এবং সম্ভল মসজিদ কবজা করতে না পারার ক্ষোভে এই ধরনের আদেশ জারি করা হয়েছে। ‘শঠে সাট্টং’ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, যোগীজি যেকোনও মূল্যে তা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর।
এদিকে সম্ভল মসজিদের ইমামের উপর প্রশাসন ২ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে। অপরাধ, মসজিদ থেকে আযানের আহ্বান। প্রশাসন বলছে, মসজিদের মাইকে প্রদত্ত আযান একটু বেশি জোরে দেওয়া হয়েছে। তাই এই জরিমানা। অর্থাৎ যেকোনও মূল্যে সম্ভল মসজিদ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে টার্গেট করা। ধর্মাচরণের যে স্বাধীনতার কথা সংবিধানে রয়েছে, তা অন্তত যোগী রাজ্যে প্রযোজ্য নয়।