সেখ কুতুবউদ্দিন: কেন্দ্রের ওয়াকফ সংশোধনী বিল বাতিল-সহ নবী সা.কে অবমাননা, ফিলিস্তিনিদের উপর লাগাতার হামলার প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে সকাল থেকেই কলকাতার রাস্তায় গাড়ির লম্বা লাইন। একটার পর একটা মিছিল দেখে তাজ্জব পথচলতি মানুষজন। বেলা বারোটা বাজার আগেই রানি রাসমণি রোডের সভাস্থলে উপচেপড়া ভিড়। রানি রাসমণি রোডে তিল ধারণের জায়গা নেই। ফুটপাতগুলিও প্রতিবাদী জনতার দ’লে। এমন সময় মঞ্চে একের পর আসেন আলেম-উলামা সহ বিশিষ্টরা। মাঠের মধ্যে থাকা লোকজন সভামঞ্চে বিশিষ্টদের দে’তে না পেরে কেউ পাঁচিলে, কেউ আবার রেলিংয়ে বা গাছে ওঠেন, আবার কেউ শহিদ মিনার চত্বরে বসে অধীর আগ্রহে বিশিষ্টদের বক্তব্য শোনেন। বক্তব্যের মাঝেই প্রতিবাদের স্লোগানও ওঠে। জনগণের স্লোগানে মু’রিত ধর্মতলা চত্বর। পুলিশ বলছে, ৮০ হাজারের বেশি মানুষ হাজির সভা স্থলে। এমনই এক জমায়েতের মাঝে বিশিষ্টদের হুশিয়ারি, মেনে নেওয়া হবে না ওয়াকফ সংশোধনী ২০২৪ বিল। জমায়েত নিয়ে কেউ আবার বলেন, বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকেই। সব মিলে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন এদিনের সভায়। সভাস্থলেই জোহরের নামায আদায় করেন তাঁরা। জমিয়তে উলামায়ের সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে চলে যেতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন জেলা থেকে আসে তিন হাজার বাস, লরি, ছোট গাড়ি। কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে কলকাতা। এত বড় সভা সুশৃঙ্খলভাবেই শেষ হয়।
বৃহস্পতিবার কলকাতার রানি রাসমণি রোডে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল-২০২৪ বাতিলের দাবিতে সরব হয় পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে উলামা। এদিনের সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট বক্তারা ওয়াকফ সংশোধনী বিলের প্রতিবাদের পাশাপাশি নবী সা.-এর প্রতি অবমাননা, ফিলিস্তিনিদের উপর গণহত্যার বিরুদ্ধেও সরব হন। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত উপচেপড়া মানুষজনের সামনে বক্তব্য রাখার সময় জনতার কণ্ঠস্বরে মুখরিত হয় সভাস্থল।
পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে উলামায়ের সভাপতি মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরির উদ্যোগে এই সভা হয়। সভা পরিচালনা করে জমিয়তের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মুফতি আবদুস সালাম। বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ক্কারী ফজলুর রহমান, পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ও পুবের কলম-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা সওবান সিদ্দিকী, পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী, বসিরহাট দরবার শরিফের পীরজাদা খোবায়েব আমীন, মাওলানা আবুল কাশেম, আমীরে শরীয়ত মাওলানা মনজুর আলম কাশেমী, মুফতি ইমদাদুল ইসলাম, আইনজীবী সৈয়দ শামসুল আরেফিন, আইনজীবী আবদুস সামাদ প্রমুখ।
কেন্দ্র সরকারের ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরির হুঁশিয়ারি, কেন্দ্র সরকার বিল পাশ করলে আমরাও তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। কারণ, এটা রাজনৈতিক তরজা করার লড়াই নয়, নিজের সম্পদ রক্ষা করার লড়াই। এটা কোনও রাজনৈতিক ইস্যু নয়, ওয়াকফ সম্পত্তিতে কেন্দ্র সরকারের ‘লালসা’ হচ্ছে। মুসলমানদের সম্পদ লুট করার চেষ্টা হচ্ছে। ৪০ পাতার সংশোধনীতে ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন ধ্বংস করতে চাইছে কেন্দ্র। জোর করে আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সংবিধানে ধর্মাচারণের স্বাধীনতা আছে। সেই স্বাধীনতাকে হরণ করার চেষ্টা হচ্ছে। এ দিকে দেশের সমস্ত বিরোধী দল ওয়াকফ আইন প্রত্যাহার চাইছে। ৬ লক্ষের বেশি একর ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। আর অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, তামিলনাড়ুতে দেবত্তোর সম্পত্তি রয়েছে ৯ লক্ষ ৪০ হাজার একর। দেবত্তোর সম্পত্তি নিয়ে কোনও কিছু করতে চায়নি কেন্দ্র। ওয়াকফ প্রত্যাহার, নবী সা.-এর অবমাননা, ফিলিস্তিনিদের উপর হামলার ইস্যু নিয়ে আগামী বছরে ব্রিগেড ময়দানে সমাবেশ করা হবে। ওয়াকফ বিল পাশ হলে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন সিদ্দিকুল্লাহ। মসজিদের ইমামরা যাতে ধর্মপ্রচার ও সমাজকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, সেবার্তাও দেন।
ক্কারী ফজলুর রহমানের বক্তব্য, সংবিধান প্রদত্ত মানুষের হক বা অধিকার বজায় রা’তে হবে। জোর করে তা ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। ওয়াকফ সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলে আমরা সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করব। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের একান্ত নিজস্ব। তাই এই সম্পত্তির অধিকার ছাড়ব না। তিনি অভিযোগ করেন, মুসলিমরা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে লড়াই করেছে। আজ তাদেরই হক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্র। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ওয়াকফ বিলের বিরোধিতায় আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার আর্জি জানান।
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন সংবিধানে ‘ওয়াকফ’ উল্লেখ নেই। ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, যুদ্ধের ফলে গাজায় মাসের পর মাস মানুষ মারা যাচ্ছে। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। জায়নবাদী ইসরাইলের হামলায় গাজাবাসীর পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও তারা মাটি কামড়ে আছেন। কেউ গাজা ছাড়েননি। ধৈর্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গাজার ছেলে হারা মা’রা বলছেন, আল্লার রাস্তায় শহিদ হয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার দোসরদের কাছে জোরালো দাবি, নিরীহ ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধ করা হোক। রাষ্ট্রসংঘের কাছে অনুরোধ করব, এই জুলুমের অবসানে তারা কার্যকরী ভূমিকা পালন করুক। বিভিন্ন রাষ্ট্রে তারা যেভাবে শান্তিরক্ষাবাহিনী পাঠিয়ে থাকে, অনুরূপভাবে এই হত্যাযজ্ঞের অবসানে ফিলিস্তিনেও শান্তিরক্ষাবাহিনী প্রেরণ করুক। জেরুসালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিক বলেও দাবি জানান ইমরান।
ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা সওবান সিদ্দিকী বলেন, সিএএ, এনআরসি, এনপিআর- বিরোধী আন্দোলনে নাগরিকত্বের অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই হয়েছে। জনগণের বিরোধিতায় কিছু করতে পারেনি কেন্দ্র সরকার। আমরা অধিকার নিয়ে লড়াই করছি। দয়া নিয়ে নয়। তাঁর হুশিয়ারি, ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকবে।
বসিরহাট দরবার শরীফের পীরজাদা খোয়ায়েব আমীনের বক্তব্য, কেন্দ্র সরকার যা খুশি তাই করতে চাইছে। ভারতের ত্রিশটি ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। রাজ্যের ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধার করা। আমরা চাই, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওয়াকফ নিয়ে লড়াই করুন। আমরা পাশে আছি। এ দিনের সভায় কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা ও নবী সা.কে অবমাননা নিয়ে বক্তব্য রাখেন পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী। পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গদি মিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।
‘নবী সা. এর জীবনদর্শনকে কালিমালিপ্ত করা চলবে না’—এই নিয়ে প্রস্তাব পাঠ করেন মাওলানা মনজুর আলম। তিনি বলেন, স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন নবী হজরত মুহাম্মদ সা. মানব জাতির আচার্য। মহাত্মা গান্ধি নবী সা.- এর জীবন সম্পর্কে আরও জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এদেশে এ’ন নবী সা.কে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা জালানো হচ্ছে। আর এভাবে নবী সা. অবমাননা করে মুসলমানদের হৃদয় বিচলিত করার চেষ্টা হচ্ছে। হিংসাযুক্ত সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সভা শেষে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক মুফতি আবদুস সালাম কর্মী সমর্থক এবং উপস্থিত সকলকে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।