১৭৫৭ খ্রিস্টাব্ধ থেকে ১৮৫৭ তক ঔপনিবেশিক আর সম্প্রসারণবাদী শক্তি এই উপমহাদেশের মুসলমান জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। ইসলামের ‘তাহজিব-তামুদ্বন’ (ধর্ম ও সংস্কৃতি) সাধারণ শিক্ষা– জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে ধুরন্ধর আর পরিকল্পিত হামলা। এই বিপজ্জনক আর হতাশাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে বিশ্বাসী ‘উম্মাহ’-কে ‘ডিগনিটি’-র স্তরে টেনে তোলার জন্য সমাজ-অভ্যন্তরীণ ‘আহল-ই-কলম'(বুদ্ধিজীবী শ্রেণি) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আর মর্যাদাশ্রিত অতি উচ্চগুণমান সম্পন্ন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এতদ্বিষয়ে তীক্ষ্ণ এক বিশ্লেষণধর্মী আলোকপাতের জন্য কলম ধরেছেন– এই উপমহাদেশ বিষয়ক ইতিহাসবেত্তা আর দেশবিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের একটি উপেক্ষিত জাতিসত্ত্বার মর্যাদার অন্বেষক খাজিম আহমেদ
আজ প্রথম কিস্তি
এই উপমহাদেশের অর্থাৎ সাবেক হিন্দুস্তানের মুসলমান ‘আহল-ই-কলম’ (বুদ্ধিজীবী শ্রেণি) দ্বারা— ইহলোক আর পরলোকের প্রয়োজনে, পরিচালিত যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতে ক্রিয়াশীল— সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই যে নামটি উচ্চারিত হওয়া জরুরি এবং অপরিহার্য সেটি হচ্ছে ‘দারুল-উলম-দেওবন্দ’– উত্তরপ্রদেশ।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আর সম্প্রসারণবাদী শক্তি এই উপমহাদেশের মুসলমান জনজীবনকে বিপন্ন করে তোলে। বস্তুত ইসলামি ভাবাশ্রয়ী হুকুমতকে নানা স্তরে– নানা অর্থে ধ্বংস করে দেয়। এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ড. ইশতিয়াক হুসেন কুরেশি মন্তব্য করেছেন যে– বহিঃশত্রুর দ্বারা যেমন নির্যাতিত হয়েছে– তেমনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও এতদ্দেশীয় মুসলমানরা পরাভব চেতনায় জর্জরিত হয়েছে। ড. কুরেশির অনুভবঃ ‘মুসলমান সম্প্রদায়ে বহু আগাছার জন্ম হয়েছিল– ধর্মের স্থান দখল করেছিল কুসংস্কার— সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় আনুগত্য স্বার্থপরতার নিকট আত্মসমর্পণ করে। (‘দ্য মুসলিম কম্যুনিটি অব দ্য ইন্দো-পাকিস্তান সাব-কন্টিনেন্ট’– পৃষ্ঠা ১২২)। ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজে অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার জাঁকিয়ে বসেছিল। (ড. রফিউদ্দিন আহমেদ– ‘দ্য বেঙ্গল মুসলিমস্– ১৮৭১-১৯০৬: আ কোয়েস্ট ফর আইডেনটিটি– পৃ. ২৩– ৩৩– ৩৫)। ‘বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনেও চূড়ান্ত অনাচার প্রবেশ করেছিল’। ড. ওয়াকিল আহমদ– ‘বাঙালি মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা– পৃ. ৫২-৫৬)
ইসলামি তাহজিব-তামুদ্বন (ধর্ম ও সংস্কৃতি)– সাধারণ শিক্ষা– জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক হামলা। এই বিপজ্জনক এবং হতাশাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে মুসলিম ‘উম্মাহ’-কে ‘ডিগনিটি’র স্তরে টেনে তোলার জন্য হাজি মুহাম্মদ আবিদ হুসেনের আগ্রহে এবং মাওলানা মুহাম্মদ কাশেম ননৌতাভির অধিনায়কত্বে মুসলিম বিদ্বৎসমাজ একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এমনবিধ ‘কেশেশ’-এর ফল হল ‘দারুল-উলুম-দেওবন্দ’। জেলা– শাহরানপুর।
১৮৬৬-৬৭ সালে এই মহতী প্রতিষ্ঠানের সূচনাকাল এবং স্থাপনা। বিশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো চরিত্র ও মাহাত্ম্য সহ সারা দুনিয়ায় ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান হিসেবে মান্যতা পেয়েছে। ইজিপ্টের আল্-আজহার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ‘দারুল-উলুম-দেওবন্দ’-এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। উনিশ শতকের শেষে মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সারা মুসলিম বিশ্বে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। স্মর্তব্য– এটি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বিশ্বের তিনটি মহাদেশ থেকে বস্তুত এখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্জনের ‘মকসদে’ আসেন। ইসলামি সভ্যতা– গ্রন্থাগারের ওপর অশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ‘দারুল-উলম’ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারে হাজারে গ্রন্থাবলী (আরবি– ফারসি– উর্দু ভাষা) জ্ঞানচর্চার জন্য সযত্নে রক্ষিত— তা যথাযথ বিস্ময়কর। গবেষণাকর্ম এবং বহুবিধ পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিরে শিরোপা পরিয়ে রেখেছে। ইসলামি সভ্যতার ওপরে চর্চিত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থরাজিও সহজেই লভ্য। ঔপনিবেশিক ভারতে কিংবা স্বাধীন ভারতে শাসক গোষ্ঠীর কোনও দয়া-দাক্ষিণ্যের পরোয়া করেন না— এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকগোষ্ঠী। দেওবন্দের উলেমা শ্রেণি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারিতেই ছিলেন। তাঁরা তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। ছিলেন তাঁরা ‘স্বদেশপ্রেমিক’ কেননা তাঁরা বিশ্বাস করতেন— ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিলাল ঈমান। অর্থাৎ ‘স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ’।একজন মুসলমান কখনও দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না।
এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং উলামা শ্রেণি অতি প্রভাবশীল ‘জমিয়ত ওলামায়ে হিন্দ-এর সঙ্গে সখ্যতার সম্পর্ক রেখে চলেন। (সূত্রঃ Faruqi, ‘The Deoband School’ নামক গ্রন্থখানি দেখুন।)
নদওয়াতুল-উলামা– লখনউ
উত্তরপ্রদেশের অভিজাত লখনউ শহরে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উপরোক্ত মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। এই ইসলামি সংস্থাটির উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণ ইসলামি জীবন পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয়সাধন। ধর্মীয় এবং দুনিয়াদারির জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার (‘উলুম-ই-আকলিয়াহ’ অর্থাৎ ‘বৌদ্ধিক জ্ঞান’– সূত্রঃ আসগার আলি ইঞ্জিনিয়ার-এর একটি ইংরেজি প্রবন্ধ থেকে) সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রবর্তন করা হয়। এমনবিধ স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডাইরেক্টর ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ আলি মুঙ্গেরি। আধুনিক ‘হিন্দুস্তান’-এর সর্বোত্তম ইসলামবেত্তা এবং ‘ভারততত্ত্ববিদ’-আল্লামা শিবলি নোমানি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার বার্তা বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেন। তিনি এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯০৪ সালে।
আল্লামা শিবলি নোমানি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা– পর্যালোচনা– পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমালোচনামূলক এবং তূলনামূলক শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন। বস্তুত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মাওলানা নোমানির নেতৃত্বে তৎকালীন উলেমা শ্রেণি দেওবন্দ আর স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলিগড় কেন্দ্রিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ (১৮১৭-১৮৯৮) অধ্যক্ষ আর্চিবন্ড– অধ্যাপক মরিসন– অধ্যাপক বেক’-এর পরামর্শে আলিগড় চিন্তাধারাকে ইসলামি আর আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তা-চর্চার সংশ্লেষণ করেছিলেন। মাওলানা শিবলি নোমানি এই বাস্তবোচিত বিষয়টিতে মান্যতা দেন এবং ‘নদওয়াতুল-উলামা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে তা গ্রহণ করেন। আল্-কুরআনের অনুবাদ– ব্যাখ্যা– মূল্যায়ন আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী ‘সিরাত-উন-নবী’ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম বৌদ্ধিক ফসল।
আরও এক ভারততত্ত্ববিদ (Indologist) ইসলামবেত্তা সাইয়েদ সুলায়মান নদভি ও নদওয়াতুল-উলামা-র অসাধারণ ধী-শক্তিসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন। আজতক তিনিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোত্তম ছাত্র। ‘আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক খ্যাতিসম্পন্ন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত– বহুল মুদ্রিত ও বহুল পঠিত বহু গ্রন্থপ্রণেতা সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক– প্রধান পরিচালক ছিলেন মৃতু্যর আগে পর্যন্ত (২০০০)- (দেখুন– ইসলামী বিশ্বকোষ– ই.ফা.বী– ১৩শ খণ্ড– পৃ.-২৮৭)
বিশ্ব সভ্যতার মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ সা. দেশপ্রেম আর গণতান্ত্রিক ঐক্য– সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ববোধের যে তালিম দিয়ে গেছেন– তা তাঁর মতো আলোকবাহী ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই এই শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেরিয়েছিল বহু তেজোদৃপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী। নানা মত– নানা ধর্মীয় নাগরিকবর্গের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জানপাত লড়াই করেছিলেন। তাঁদের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল হর হিন্দুস্তানি আপন মর্যাদা আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সাদিয়োকাল থেকে যে সৌভ্রাতৃত্বের সঙ্গে বসবাস করে আসছে— সেই ট্র্যাডিশন জারি থাকবে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অগণন ছাত্র প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছেন। ‘শুধুমাত্র দিল্লিতেই ৭০ হাজারেরও বেশি আলেমকে নিধন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ইসলামি মাদরাসায় ছাত্রদের ভূমিকা– সাইয়েদ হুসাইন আহমদ শামসী– ইসলামি সংস্টৃñতি– ৫ম সংখ্যা– পৃ.-২৬)
মাওলানা– মৌলবি– আলেম– উলেমা— এককথায় ইসলামাশ্রয়ী ‘আহল-ই-কলম(বুদ্ধিজীবীবর্গ)’আযাদি সংগ্রামে’ যে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন তার যথার্থ মূল্যায়ন আজও হল না। বিশিষ্ট কয়েকজনের নাম শ্রদ্ধাসহকারে উল্লেখ করা হল মাওলানা মাহমুদল হাসান– মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি– মাওলানা হিফজুর রহমান– মাওলানা আবুল কালাম আজাদ– মাওলানা ফজলুল হক খয়রাবাদি– মাওলানা হেদায়েত রাসুল কাদরি– মাওলানা মুহাম্মদ আলি গওহর– মাওলানা হযরত আলি মোহানি– মাওলানা আহমদুল্লাহ শাহ– মাওলানা আহমদ সয়ীদ– মাওলানা ইসমাইল মিরাটি– মাওলানা আবদুর রহিম– মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি– মুফতি এনায়েত আহমদ কাকোরি এবং কোটি কোটি জনবন্দিত মাওলানা মুহাম্মদ কাশেম নানাতোভি। স্পষ্ট করে বলা দরকার– বেশুমার ‘ওলামায়ে-হিন্দ’ আযাদি সংগ্রামে নিজেকে ‘জান-বাজি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। (সূত্রঃ প্রাগুক্ত এবং অমলেন্দু দে– ‘ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুসলিম সমাজ’-‘চতুরঙ্গ’-বর্ষ ৪৮– সংখ্যা-৭– নভেম্বর-১৯৮৭)
‘নদওয়াতুল-উলামা-লখনউ’-র পরেই উল্লেখ করতে হবে ‘মযহার-উল-উল্ম’ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। এটি শাহরানপুরে অবস্থিত। ‘দারুল-উলম’ এর সঙ্গে শিক্ষাপদ্ধতির প্রকৃতিগত এবং গুণগত সামঞ্জস্য রয়েছে। ‘হিন্দুস্তানি’ মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা উন্মেষ আর উজ্জীবনে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য।
এমনবিধ বৃহৎ আর মহৎ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান– মাদ্রাসা– ধর্মীয় আর ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যায়তন এবং ইসলামি আদর্শে পরিচালিত সংস্থা রয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। এগুলোর মধ্যে ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ কলকাতা)– ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া শামসুল হুদা'(পটনা)– ‘মাদ্রাসা-ই-আজিজিয়া'(বিহার শরীফ)– ‘মাদ্রাসা-ই-নিজামিয়া’-হায়দরাবাদ)– ‘মাদ্রাসা-উল-উজেন’-লখনউ) এবং ‘মাদ্রাসা-ই-নিজামিয়া’ (লখনউ)বিশেষভাবে মর্যাদাসম্পন্ন আর গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রমশ…