৯ মে ২৫তম প্রয়াণ দিবস অতিক্রান্ত হল। এর মধ্যেই কি আমরা ভুলে গেলাম চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক কাঁপানো নায়ক-গায়ক তালাত মাহমুদকে? বর্তমান প্রজন্ম জানে কি তাঁর মতো রোমান্টিক নায়ক-গায়কের কথা? আগামী বছর জন্ম শতবার্ষিকীর আগে শিল্পীকে স্মরণ করলেন প্রদীপ মজুমদার
‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়/ মনে পড়ে মোরে প্রিয়
চাঁদ হয়ে রবো আকাশের গায়/ বাতায়ন খুলে দিয়ো।’
অথবা,
‘রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে, কি হবে তোমার/ কাছে কেউ না এলে আর/ মনের ওই এত মধু কেন জমেছে/ যদি কেউ না থাকে নেওয়ার।’
কিংবা,
‘এই রিমঝিম ঝিম বরষায়…’দুটি পাখি দুটি তীরে… এইসব কালজয়ী গান এখনও হয়তো কোনও কোনও শিল্পীর কণ্ঠে ‘রি-মেক’ হয়ে শোনা যায়। এখনও গানগুলি দূর থেকে ভেসে এলে মন আনচান হয়ে ওঠে সেইসব মানুষদের, যাঁদের বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। কারণ, এই গানগুলিই ছিল তাঁদের যৌবনের ভালোবাসা, তারুণ্যের আবেগ। আজকের যুগেও অনেকে এই গানগুলির কোনওটা হয়তো শুনেছেন, কিন্তু কয়জন বা বলতে পারবেন, কে এই গানগুলির কণ্ঠশিল্পী? কার সুরেলা কণ্ঠে গানগুলি মাতাল করে দিয়েছিল ফেলে আসা শতকের ৪০, ৫০, ৬০-এর দশকগুলি? কতজন এখন বলতে পারবেন, তালাত মাহমুদের কথা!
হেমন্ত, মান্না, মানবেন্দ্ররা যখন বাংলা গানের স্বর্ণযুগ এনেছিলেন, সেই সময় তাঁদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে গেছেন একজন অবাঙালি শিল্পী। প্রথমে ‘তপন কুমার’ নাম নিয়ে বাংলার গ্রামোফোনের গালার রেকর্ডের মাধ্যমে হাজির হলেও খুব অল্প দিনেই মুগ্ধ শ্রোতারা আবিষ্কার করে ফেলেন সেই তপন কুমার ছদ্মনামের আড়ালে থাকা তালাত মাহমুদকে। এক-একটি গানের সুরের ঝঙ্কারেই শ্রোতাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত হিন্দি সিনেমায় নায়কের অভিনয় করা, নিজের কণ্ঠের জাদুতে দর্শকদের মাতাল করা সুন্দর মুখটি। তাঁকে এক সময় গজল সম্রাট বলা হত। এখনও প্রখ্যাত গজলশিল্পী পঙ্কজ উদাস তাঁকে ‘শাহেনশাহ-ই-গজল’ নামে অভিহিত করে থাকেন। কলকাতায় অবস্থান করা তৎকালের বিখ্যাত গজলশিল্পী উস্তাদ বরকত আলি খান, কে এল সায়গলের মতো বিখ্যাত শিল্পীরাও তালাত মাহমুদের গজলের তারিফ করে গেছেন।
হিন্দি, উর্দু,, গুজরাতি, বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় অজস্র গান গেয়েছেন তালাত মাহমুদ। ৭৫ বছর বয়সে তিনি অগণিত শ্রোতা-দর্শকদের কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিয়েছিলেন ১৯৯৮ সালে। সেই দিনটি ছিল ৯ মে। অর্থাৎ কয়েকদিন আগে নীরবে অতিক্রান্ত হল এত বড় একজন শিল্পীর ২৫তম ইন্তেকাল দিবস। শ্রোতারা তাঁকে ভুলেই গেছেন। কারণ, মৃত্যুর অনেক আগেই অসুস্থতার কারণে তাঁকে গান ছাড়তে বাধ্য হতে হয়। দশককালেরও বেশি সময় অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে তাঁকে। তবুও ১৯৯৮ সালের ৯ মে তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে সেদিন মুম্বইবাসীদের মতো বাংলার মানুষও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। চোখের কোণের জলের ধারা মুছেছিলেন উপমহাদেশের বহু মানুষ। সকলেরই সেদিন মনে পড়েছিল সেই রোমান্টিক গান— ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সে জাগা লে চল/ যাহা কোই না হো’ কিংবা ‘এ মেরে দিল কাহা আউর চল’।
তালাত মাহমুদের জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসেবে আগামী বছর তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী। উত্তরপ্রদেশের সুরের রাজধানী লখনউতে তাঁর জন্ম। এই ল’নউ-এ তাঁর পৈতৃক বাসস্থান। তিন ভাই, তিন বোন ছিলেন তালাতরা। ভাই-বোনদের কেউই গানের লাইনে আসেননি। শুধু তালাতই এসেছেন। ছোটবেলায় কড়া শাসনের মধ্যে থাকলেও যৌবনে তাঁর অসামান্য সৌন্দর্য এবং সুরেলা কণ্ঠ তাঁকে মুম্বইয়ে টেনে নিয়ে যায়। নিজের দক্ষতা দিয়ে জাত বোঝাতে খুব বেশি কালক্ষেপণ করতে হয়নি।
তালাতের এই অপূর্ব কণ্ঠ তাঁর জন্মগত। ছোটবেলা থেকেই তাঁর গলা সবাইকে বিমোহিত করত। তবুও কিশোর বয়সে কখনও গলা ছেড়ে গান করেননি রাগী পিতার ভয়ে। তাঁর আব্বা মঞ্জর মাহমুদকে সকলেই বলতেন, তালাতের স্বর্ণকণ্ঠের কথা, তিনি তাতে আমল দেননি। কারণ, তিনি চাননি গান গেয়ে ছেলে রোজগার করবে, সিনেমায় কাজ করবে… তাই রাত জেগে শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতেন তালাত।
কিন্তু তালাতকে তাঁর পরিবারের কড়া শাসনও ধরে রাখতে পারল না।
লখনউ-এ সংগীত শিক্ষালয় মরিস কলেজ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেখানে ঢুকে পড়লেন। সেখানে তিন বছর কেটেছে তাঁর। সে সময় বিখ্যাত ওস্তাদদের সঙ্গে এবং চিত্রজগতের অনেকের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। পরিচয় হয়েছিল হিন্দি সিনেমার নায়িকা স্বর্ণলতার সঙ্গে। তাঁরাও তখন সেখানে তালিম নিতেন। সংগীত কলেজে পড়ার সময় তালাত বিশেষ করে কুন্দনলাল সায়গলের মধুময় কণ্ঠকে কপি করতে শুরু করলেন। কিন্তু তাতে কাজে দিচ্ছিল না। অবশেষে নিজের মতো করে গান গাইতে শুরু করেন বড় বড় ওস্তাদদের পরামর্শে। তাতেই কাজ হল। ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়া রেডিয়ো লখনউ কেন্দ্র থেকে তাঁর গান প্রথম সম্প্রচারিত হয়। সে সব ছিল উর্দু গজল। তারপর দিল্লি, লাহোর, পেশোয়ার কেন্দ্রের বেতার শিল্পী হিসেবেও অনেক গান গেয়েছেন।
তালাত মাহমুদ প্রথম কলকাতায় আসেন ১৯৪২ সালে। এইচএমভি কোম্পানিতে তিনি প্রথম রেকর্ড করলেন ‘তসবির তেরি দিল মেরা বহলানা সকেগি’ গানটি। এই গানই তাঁকে রাতারাতি খ্যাতির উচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করে দিল। এরপর তাঁর নাম স্থায়ী হয়ে গেল হিজ মাস্টার্স ভয়েজের শিল্পী তালিকায়।
সে সময় অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর কাছে অভিনয় করার অফার এলো ‘মৌচাকে ঢিল’ ছবিতে, সেটা ১৯৪৬ সাল। প্রমথেশ বড়ুয়ার হিন্দি ছবি ‘রাজলক্ষ্মী’তে তালাত প্রথম প্লে ব্যাক করার সুযোগ পান।
১৯৪৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজলক্ষ্মী’ সিনেমায় তিনি গেয়েছিলেন ‘জাগো মুসাফির জাগো’ গানটি। এরপর তিনি বেশ কয়েক বছর কলকাতায় ছিলেন। তখন তপন কুমার নামে কয়েকটি গানের রেকর্ড করেন। কলকাতায় হিন্দি ছবি ‘সমাপ্তি’তে অভিনয়ও করেছিলেন চল্লিশের দশকের শেষের দিকে। সমাপ্তিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন ভারতীদেবী। ছবিটি অবশ্য তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। এর আগে ‘সাত নম্বর বাড়ি’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘আজ কথা নয়’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা ছবি ‘পতিব্রতা’ ‘পথ বেঁধে দিল’ ‘মৌচাকে ঢিল’ প্রভৃতিতেও তিনি অভিনয় করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দি ‘তুম আউর ম্যায়’ ছবিতে কাননদেবীর সঙ্গেও অভিনয় করেছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি বাঙালি কন্যা নাসরিনকে বিবাহ করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার মাধ্যমে ভারত ভাগ হল। সেই স্বাধীনতার আনন্দ আর দেশভাগের যন্ত্রণার মধ্যে বাংলার মানুষ তালাত মাহমুদের কণ্ঠে শুনল সেই কালজয়ী গান ‘দুটি পাখি দুটি তীর/ মাঝে নদী বহে ধীরে।’
গানটির সুর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। ১৯৪৯ সালে তালাত চলে গেলেন কলকাতা ছেড়ে তৎকালীন বোম্বে, যা অধুনা মুম্বই। তখন সংগীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস কাজ করছিলেন শহিদ লতিফের ‘আরজু’ ছবিতে। আগেই তালাতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাই আরজুতে প্লে ব্যাক শিল্পী হিসাবে কাজ পেলেন তালাত। দিলীপ কুমার ও কামিনী কৌশলের অভিনয়ের সঙ্গে তালাত মাহমুদ ও লতা মুঙ্গেশকরের নেপথ্য গানের কণ্ঠ ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল দর্শকদের মধ্যে। আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে— ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সে জাগা লে চল…’ গানখানি, অথচ এই গানটি তালাত ও লতা গেয়েছিলেন ৬৮ বছর আগে। এরপর নৌশাদের মনমাতানো সুরে তালাত ‘বাবুল’ ছবিতে গান করলেন— ‘মিলতেহি আঁখে দিল হুয়া দিওয়ানা’। এই গান এখনও প্রবীণদের মুখে মুখে ফেরে।
হিন্দি ‘আরাম’ ছবিতে গায়ক ও নায়ক হিসাবে তালাত মাহমুদ দর্শকদের মন কাড়েন। সেটা ছিল ১৯৫০ সালের কথা। ১৯৫২ সালে ‘দিল এ নাদান’ ছবিতেও নায়কের ভূমিকায়।
এরপর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘ওয়ারিশ’ ‘ডাকবাবু’ ‘মালিক’ ‘কিনারে কিনারে’ ‘এক গাঁও কি কাহানি’ ‘রাফতার’ ‘লালরু’ প্রভৃতি হিন্দি ছবিতে। ‘মালিক’ এবং ‘ওয়ারিশ’ ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন সুরাইয়া। ‘রাফতার’ ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন নাদিরা।
তালাত মাহমুদ ২০০ ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠে গান গেয়েছেন। আরজু, দাগ, বাবুল, আনমোল, রতন, নাগমা, তারানা, দো রাহে, আনহোনি, নৌবাহার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
দিওয়ানা ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘তসবির বানাতা হু খুনে জিগর সে’ গানটি হিন্দি সিনেমার গানে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এছাড়া রয়েছে আরও অগুনতি অবিস্মরণীয় গান। তাঁর মোট গানের সংখ্যা ৮০০।
১৯৫৯ সালে তালাত মাহমুদ ঢাকায় যান। সে সময় তিনি বাংলা ছবি ‘রাজধানীর বুকে’তে তাঁর গাওয়া ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’, গানটি আরও অন্তত দুই দশক ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। সে সময় তিনি গুলিস্তান প্রেক্ষাগৃহে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন।
তাঁর গাওয়া সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘এই রিমঝিম ঝিম বরষা, ভি বালসারার সুরে ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও, ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, এই তো বেশ এই নদীর তীরে, ‘কথা নয় আজ রাতে’ রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘চাঁদের এত আলো, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘এ যদি আকাশ হয়, তোমায় কি বলে আমি ডাকব বলো’ প্রভৃতি চিরকালই বাংলা সংগীত ভাণ্ডারের অমূল্য রতন হয়েই থাকবে। চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে গোটা ভারতে তিনজন পুরুষশিল্পীর মধ্যে প্রতিযোগিতা জারি ছিল। তালাত মাহমুদকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে মুহাম্মদ রফি এবং মুকেশের সঙ্গে। ১৯৪৪ সালে তাঁর গানের রেকর্ড সর্বাধিক বিক্রিত হিসাবে জায়গা করে নেয়। ভারত সরকার তাঁর সংগীতের স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৯২ সালে যখন পদ্মভূষণ পুরস্কার দেন, তখন তিনি রোগসজ্জায় ছিলেন।
সেই অসাধারণ শিল্পীকে আমরা যেন ভুলতে বসেছি। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শোনেনি তালাত মাহমুদের নাম। তারা পারেনি তাঁর কণ্ঠসুধার রসাস্বাদন করতে। সেই শিল্পীর জন্ম শতবর্ষ আগামী বছর ২০২৪-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি। বাঙালি তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সংগীত জগৎ কি তাঁকে নতুন করে স্মরণ করবে না?